শিরি-ফরহাদের স্মৃতিময় শহরে

কবি ভাহশি বাফগির পাণ্ডুলিপিতে সচিত্র বিবরণ
ছবি: সংগৃহীত

পৃথিবীতে দেশকালভেদে অসংখ্য প্রেমকাহিনি বিদ্যমান রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রোমিও-জুলিয়েট, ইউসুফ-জুলেখা, লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ, খসরু-শিরিনের অমর প্রেমকাহিনি এখনো মানুষের মুখে মুখে রূপকথার ন্যায় প্রচলিত। হালের টাইটানিক সিনেমার প্রেমকাহিনিই–বা বাদ যাবে কেন? ইরানে পিএইচডি গবেষণায় অধ্যয়নরত অবস্থায় খুব বেশি আগ্রহ ছিল শিরি-ফরহাদের স্মৃতিবিজড়িত স্থান কেরমান শাহ প্রদেশ ভ্রমণে যাব। ফারসি সাহিত্যের বিখ্যাত কবি নিজামি গানজুবি, ভাহশি বাফগিসহ ফারসি সাহিত্যের অসংখ্য কবির কবিতায় শিরি-ফরহাদ বা খসরু-শিরিনের বিখ্যাত সব কাহিনি উঠে এসেছে।

রাজধানী তেহরান থেকে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কেরমান শাহ প্রদেশ। ৩১ মার্চ ২০১৬ সালে শিরি-ফরহাদের স্মৃতিবিজড়িত বিসোতুন পর্বতটি কাছ থেকে দেখার জন্য ভ্রমণ করি। ইরানের ভৌগোলিক ইতিহাসে কেরমান শাহ প্রদেশের বিসোতুন পর্বতটির গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা এর পাশ দিয়ে অতিক্রম করা মহাসড়কটি অ্যাকামেনিড রাজত্বকাল (খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫০-খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩০/৩২৭ অব্দ) থেকে শাহি সড়ক নামে পরিচিত। বর্তমানে সড়কটি হামেদান, কাঙ্গাভার, সাহনে, শিরিনের প্রাসাদ হয়ে একেবারে দজলা ও ফোরাত নদীকেও সংযুক্ত করেছে। সড়কটি প্রাচীনকালে প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ও পারস্য সাম্রাজ্যের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোকে সংযুক্ত করেছিল। এই মহাসড়ক বিসোতুনের সমতল প্রান্তর ও পার্‌ভ পাহাড়ের প্রান্তদেশ দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। বিসোতুন এলাকাটি সিল্ক রোডের ওপরে থাকায় অতীতে বিশ্রামাগার হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। এ কারণে কেউ কেউ বিসোতুনকে যাগরোস পর্বতমালার সদর দরজাও বলেছেন। জার্মানির বিশিষ্ট পুরাতত্ত্ববিদ ও ইরান বিশেষজ্ঞ আর্নল্ড এমিল হার্জফেল্ড আরও এক ধাপ এগিয়ে বিসোতুনকে এশিয়ার দ্বার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১ হাজার ৩২০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত বিসোতুন শহরটি ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত শুধু একটি গ্রাম ছিল। সে বছরই বিসোতুন পর্বতের প্রান্তদেশ ঘিরে একটি ছোট্ট শহর গড়ে ওঠে। বিসোতুন শহরটির পূর্বে রয়েছে শিরি-ফরহাদের সমাধিখ্যাত সাহনে দারবান্দ নামক ছোট্ট শহরের অবস্থান। মাত্র ২ হাজার ৪৫৫ জনের বসবাসকারী শহরটিতে ইরানের নববর্ষকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন প্রদেশের পর্যটকেরা ভিড় করে থাকেন।

বলা হয়ে থাকে ফরহাদ এ স্থান থেকে পড়ে গিয়েই মৃত্যুবরণ করেন
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

বিসোতুন পাহাড়ের গায়ে খোদাই করে খ্রিষ্টপূর্ব ৫২১ অব্দ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮৬ অব্দ পর্যন্ত অ্যাকামেনিড রাজত্বের মহান সম্রাট সাইরাসের বিভিন্ন রাজ্য বিজয়ের কাহিনি অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরা হয়েছে। প্রাচীনকালে এই শহরের পাশ ঘেঁষে রাজধানী বাবেল ও মাদ রাজত্বকে সংযুক্তকারী একটি মহাসড়ক বিদ্যমান ছিল। এই শহরের পাশ দিয়ে অসংখ্য লোক যাতায়াত করত বলে একেবারে যথোপযুক্ত স্থান নির্বাচন করা সাইরাসের বিচক্ষণতার পরিচয় ছিল বলেই অনুমিত।

ফরহাদের পাথর খোদাই: সাসানি সম্রাট খসরু পারভেজ দারিয়ুশ দ্য গ্রেটের মতোই বিসতুনের গাত্রে শিলালিপি খোদাইয়ের অভিপ্রায় করেছিলেন। সাসানিদের (রাজত্বকাল ২২৪-৬৪২ খ্রিষ্টাব্দ) সিরিয়া, জেরুজালেম ও মিসরের কিছু অংশ বিজয় করেন। অতঃপর খসরু পারভেজের নির্দেশে ফরহাদ কেরমানশাহ প্রদেশে অবস্থিত তাকে বোস্তান ও কুহে বিসতুনে পাথর খোদাই করে বিজয়গাথা লেখার নির্দেশ দেন (যদিও এ বিষয়ে আরও কয়েকটি গল্প প্রচলিত রয়েছে)। কিন্তু এই পাথর খোদাইকর্মও সাসানি আমলের অন্যান্য ইমারতের ন্যায় অসমাপ্ত থেকে যায়। খসরু পারভেজের মৃত্যুর পর তাঁর পরবর্তী বংশধরেরা রোমানদের সঙ্গে ক্রমাগত যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন এবং পরিশেষে আরবদের দ্বারা হামলায় সাসানি সাম্রাজ্যের পুরোপুরি পতন ঘটে। ফলে বিসতুন পর্বতে ফরহাদের অসমাপ্ত খোদাইকর্মটিও সেভাবেই থেকে যায়।

বিসোতুনের পর্বতের শিলালিপি
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

শিরিনের প্রেমিক ফরহাদের এ পাহাড় সমতল বা ছাঁচ করার প্রক্রিয়াটি দৈর্ঘ্যে ২০০ মিটার এবং প্রস্থে ৩০ মিটার, যা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পাহাড় ছাঁচ করা বা সমতল করার প্রক্রিয়া হিসেবে পরিগণিত হয়। এটি সাইরাস দ্য গ্রেটের শিলালিপি থেকে ৩০০ মিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। কথিত আছে যে খসরু পারভেজের সহধর্মিণী রানী শিরিনের প্রেমে প্রভাবান্বিত হয়ে প্রেমিক ফরহাদ পাহাড় কেটে পাথর মসৃণ বা চাঁছা শুরু করেন এবং শিরিনের প্রাসাদে পানিপ্রবাহের একটি সহজ পথ তৈরি করার কাজ শুরু করেন। পরে এখানেই ফরহাদ এক বৃদ্ধ মহিলার কাছ থেকে প্রেমিকা শিরিনের মৃত্যুর মিথ্যা খবর শুনে হাতের কুঠারটি আকাশে নিক্ষেপ করেন এবং সেটা নিচে এসে সরাসরি ফরহাদের বুকে বিদ্ধ হয়। এভাবেই প্রেমিক ফরহাদের জীবনাবসান ঘটে।

বিসোতুন পর্বত থেকে দূরে দেখা যাচ্ছে সাসানি মহল ও শাহি সড়ক
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

সাসানি মহল: সমবাহু চতুর্ভুজের ন্যায় এই মহল ফরহাদের পাথর ছাঁচকর্মের বরাবর পূর্ব-পশ্চিম দিকে এবং হামেদান-কেরমানশাহ প্রাচীন মহাসড়কের নিচের দিকে অবস্থিত। মহলটি ১৩৯ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৮৩ দশমিক ৭৫ মিটার প্রস্থবিশিষ্ট। পারস্য কবি নিজামি গাঞ্জুবির কাব্য থেকে জানা যায় যে এই মহলের বারান্দা থেকেই শিরিন–ফরহাদের পাথর খোদাইকর্ম পর্যবেক্ষণ করতেন। এই প্রাসাদে বসেই শিরি ও ফরহাদের মধ্যে অসাধারণ কথোপকথন হয়েছিল। ফরহাদের মৃত্যুসংবাদ শুনে শিরিন অসুস্থ হয়ে এখানেই মৃত্যুবরণ করেন। ভিন্নমতও রয়েছে, কেউ কেউ লিখেছেন ফরহাদের মৃত্যুসংবাদে ব্যথিত হয়ে শিরিন আত্মহত্যা করেছিলেন। কেরমান শাহ ও ইলাম প্রদেশের অঞ্চলজুড়ে রয়েছে শিরি ও ফরহাদের অসংখ্য স্মৃতিবিজড়িত স্থান।