ঘুম থেকে উঠেই হকচকিয়ে গেলাম। আশপাশের সব সিট ফাঁকা। পেছন থেকে কেউ একজন বাজখাঁই কণ্ঠে বলছে, ব্যাপারটা ওয়াও না? কী দারুণ না? কেডা জানি মুইত্তা পানি লয় নাই রে। আরে ড্রাইভার, অই মনে হয় মুইত্তা পানি লয় নাই। হের কারণেই আজকে এই অঘটনটা ঘটছে। হা হা হা।
আমি ভ্রু কুঁচকে পেছন ফিরে তাকালাম। মধ্যবয়স্ক একটি লোক ফোনে এই সব উদ্ভট কথাগুলো বলছে। তার পরনে পাঞ্জাবি। চিবুকে একগাছি দাড়ি। তার মুখভর্তি হাসি। মনে বেজায় আনন্দ। যেন কাউকে মহৎ কোনো কথা জানাতে পেরে সে গর্বিত। একই রকম আনন্দলোচনে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে তার সাঙ্গোপাঙ্গরাও। যেন বিরাট আনন্দের কোনো ব্যাপার ঘটেছে।
লক্ষ করলাম, আমাদের ট্রেনটা একটি স্টেশনে এসে থেমে আছে। নির্মিতব্য স্টেশনটি আমার অপরিচিত। তবে এটা নিশ্চয় চট্টগ্রামের কাছাকাছি কোনো স্টেশন হবে। এখন বাজে ভোর ৫টা ২২। সাতটার মধ্যে পৌঁছানো যাবে। শাটল ধরতে পারব। শাটল ছাড়বে সাড়ে সাতটায়। মনে মনে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।
ট্রেনে উঠেছিলাম রাত ১টা ৫০–এর দিকে। ঢাকা টু চট্টগ্রামগামী তূর্ণা নিশীথা। ঈদ কাটিয়ে কর্মব্যস্ততায় ফেরা সকলের। প্ল্যাটফর্মে নামলাম। ট্রেনের অর্ধেক যাত্রীই দেখি প্ল্যাটফর্মে হাঁটাহাঁটি করছে। কী ব্যাপার? স্টেশনটা একটা নিরালা বিরান এলাকায়। পাশ দিয়ে একটা সরু রাস্তা ও ছোটখাটো কিছু টংদোকান বাদে আশপাশে আর কিছু নেই, যা দেখে ঠিক বোঝা যাবে স্টেশনটা কোন অঞ্চলের। বিরান জায়গাটা কাজে লাগানো হয়েছে পাথর ভাঙার মেশিন ও বিশাল কিছু পাথরের স্তূপ দিয়ে। আমি সফরসঙ্গীদের খোঁজে প্ল্যাটফর্মের এদিক-ওদিক একটু হাঁটাহাঁটি করলাম। কাউকে পেলাম না। এই সফরে আমার সফরসঙ্গী হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনে এসে সাক্ষাৎ হওয়া আটজন জুনিয়র ও ব্যাচমেট মঞ্জু। মঞ্জু ক বগিতে। আর আমাদের বগি ঞ।
ট্রেনটা এখানে স্টপ করেছে কেন, ঠিক বুঝতে পারছি না। ঘটনা কী ঘটেছে জানতে চার-পাঁচজনের একটি জমায়েত দেখে এগিয়ে গেলাম। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, চাচা মিয়া, হয়েছে কী?
চাচা মিয়া আফসোসের গলায় বললেন, সবই নসিবের খেলা বুঝলেন। মাইনষ্যে ট্রেনের টিকিট পায় না। আর আমরা টিকিট পাইয়াও কাম সারা।
পাশ থেকে একজন ভদ্রলোক বলে উঠল, ভাইজান, বিপদের তো কোনো হাত-পাউ নাই। কথা কি ঠিক বলিয়াছি?
চাচা মিয়া বলল, হ, কথা সত্যই। বিপদের কি আর মা-বাপ আছে!
আমি বললাম, কিন্তু বিপদটা কী?
চাচা মিয়া একটু বিরক্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, হুই মিয়া, আছিলেন কই? সামনে ট্রেন এক্সিডিন করছে। আমাগো ট্রেন রাজাপুর আউট সাইড গিয়া পরে আবার পেছন ফিরা আইসা এখানে খাড়াই আছে এক ঘণ্টা হইল।
কী কাণ্ড!
এটা কোন স্টেশন?
শশীদল।
লাকসাম পার হয়েছে?
আরে লাকসাম যাইব কইত্তে? কুমিল্লাই তো পৌঁছাইতে পারে নাই।
বলেন কী?
হ। এল্লাইগ্যাই তো সবাই খাড়াই আছি বাইরে।
কখন সব ঠিক হবে, কতক্ষণ লাগবে কিছু বলেছে?
ম্যালা সময়ের ব্যাপার। আল্লাহ আল্লাহ করেন। আল্লাহর হুকুম পাইলেই ঠিক হইব।
আমি আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে জমায়েত থেকে সরে এলাম। সফরসঙ্গী জুনিয়রদের দেখলাম স্টেশনের বাইরে দূরের একটা টংদোকান থেকে ফিরছে। এসেই হাসি দিয়ে আকিব বলল, ভাই, অবস্থা দেখলেন?
তার হাসি দেখে মনে হচ্ছে আনন্দপূর্ণ কোনো অবস্থা। আমি বললাম, ঘটনা শুনলাম। গিয়েছিলে কোথায়?
খেতে গিয়েছিলাম, ভাই। ৫ টাকার পরোটা ১০ টাকা করে রাখল।
নাহিদ বলল, ঝোপ বুঝে কোপ মারছে, ভাই।
তা তো মারবেই। কিন্তু তোমরা এত দূর খেতে গেলে যে...যদি এরমধ্যে ট্রেন ছেড়ে দিত?
ভাই, কী যে বলেন! যে অবস্থা, দু-তিন ঘণ্টায়ও ট্রেন ছাড়ার সম্ভাবনা নাই।
তা–ই নাকি?
জি ভাই। অবস্থা বেগতিক।
ছয়টার দিকে দেখলাম, পাশের রেললাইন ধরে একটা ইঞ্জিন টেকনিক্যাল টিমের ট্রেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে। চারটায় ঘটা দুর্ঘটনার জায়গা পর্যবেক্ষণ ও মেরামত করতে কর্তৃপক্ষ দুই-তিন ঘণ্টা পরে যাবে, এটা এ দেশে নতুন কিছু নয়। এ দেশে সমস্যায় পড়তে সময় লাগে না। সমস্যার সমাধান হতে সময় লাগে। ধৈর্য ধরতে হয়। সবাই ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগল। একটা দল অবশ্য এখনো ঘটনা কিছুই জানে না। তারা ভেতরে ঘুমাচ্ছে। আপাতত সবচেয়ে শান্তিতে আছে তারাই। আরেকটা দল অধৈর্য হয়ে ইতিমধ্যে স্টেশন ছেড়েছে। তারা বাই রোডে যাবে। আরও অনেকে সেই চিন্তা করছে। আমি ও আমার বেকার দলের এখনই সে রকম কোনো চিন্তা নেই। দেরিতে পৌঁছানোয় আমাদের চাকরি ছুটে যাবে, এমন কিছু নেই। আমরা ঘুরছি–ফিরছি। দেখা যাক কী হয়।
সাতটার দিকে এক স্টাফকে জিজ্ঞেস করলাম, মামা, কতক্ষণ লাগতে পারে?
স্টাফ নাচতে নাচতে বলে গেল, ঠিক নাই। সন্ধ্যার আগে সম্ভব না।
এ দেশে ট্রেনের স্টাফরা হলো শার্ট-প্যান্ট ইন করে পরা পাগলশ্রেণির লোক। তাদের কিছু জিজ্ঞেস করে সদুত্তর পাওয়ার আশা করাটা ভুল। গেলাম দুজন জুনিয়রকে নিয়ে চা-নাশতা খেতে। স্টেশনের পাশে এক গলিতে দোকান। গরম গরম তেলের পিঠা নিলাম। খাচ্ছি, এমন সময় পকেটে ফোন বেজে উঠল। ফোন তুলে দেখি, কৌমি। আরে! ব্যাপার কী? গতকাল রাতেই মাত্র ক্লাস শুরুর অ্যানাউন্স করলাম। এর মধ্যেই সাতসকালে কল। ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ হওয়ার এই বুঝি ঝামেলা।
হ্যালো, এইটা তুমি না?
হ্যালো কৌমি।
হ্যাঁ, এইটা তুমি না?
কোনটা? বলে আমি ট্রেনের দিকে তাকালাম। দেখি ঝামেলা কিছু না। গলিবরাবর পথের বিপরীতে ট্রেনের জানালার ফাঁক দিয়ে কৌমিকে দেখা যাচ্ছে। আচানক ব্যাপার। আমি বললাম, আমি চা–টা খেয়ে আসছি।
কৌমি আমার ক্লাসমেট। গাজীপুরের মেয়ে। সে এয়ারপোর্ট স্টেশন থেকে উঠেছে। সেখান থেকে এখন অবধি ট্রেনেই। আরও কতক্ষণ যে লাগবে, কে জানে।
মানুষ ভুল কাজটাই বারবার করে। আটটার দিকে আরেকজন স্টাফকে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, আসলেই সময় কত লাগবে বলুন তো। নাকি এখনই নেমে বাস ধরব?
স্টাফ বলল, খবর যা পেলাম, আরও দুই ঘণ্টা অন্তত লাগবে।
দুই ঘণ্টা তো ব্যাপার না। কিন্তু আপনাদের দুই ঘণ্টা মানে তো চার ঘণ্টা। সমস্যা সেখানে।
বেলা ১০টার দিকে দেখলাম, আমাদের অর্থনীতি বিভাগে সদ্য প্রভাষক হওয়া সিনিয়র হিরামণি আপুও এই ট্রেনে। প্ল্যাটফর্মে হাঁটাহাঁটি করছেন। তাঁর সাথে গিয়ে মঞ্জু ও আমি কথা শুরু করলাম। সাথে যোগ দিলেন আপুর হাজব্যান্ড পলাশ স্যার। তিনি খুব সম্ভবত মনোবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক। আপু বললেন, এতক্ষণ তো ভালোই ছিল। এসিতে আরামসে ঘুমিয়ে ছিলাম। এসি বন্ধ করায় হয়েছে মুশকিল। ভেতরে দুর্গন্ধ হচ্ছে।
আমি বললাম, আপু, কী করবেন এখন? বাসে চলে যাবেন নাকি?
চলে যেতাম। কিন্তু সাথে বিরাট লাগেজ। এসব নিয়ে ছোটাছুটি করে পোষাবে না। তারচে বরং দেখি আরও কিছুক্ষণ।
মঞ্জু বলল, আপু, কুমিল্লায় কোনো রিলেটিভ থাকলে ওখানে গিয়ে রেস্ট করতে পারেন তো। পরে লাইন ক্লিয়ার হলে কুমিল্লা স্টেশন থেকে উঠে গেলেন।
তা করা যায়। কিন্তু ঠিক হতে যে কতক্ষণ লাগে, তা–ই তো নিশ্চিত না।
দুপুরের আগে হবে বলে মনে হয় না।
আপুর হাজব্যান্ড বললেন, আমি নয়টার নিউজে দেখলাম আর দুঘণ্টার মতো লাগবে।
মঞ্জু কনফিডেন্টলি বলল, দুই ঘণ্টাতে কোনোভাবেই সম্ভব না। বলেই ফেসবুকে পাওয়া ঘটনাস্থলের কিছু স্থিরচিত্র স্যারকে দেখালেন। রেললাইন ডিরেল হওয়ার পাশাপাশি একটি ছোট ব্রিজও ভেঙে গেছে।
স্যার বললেন, তাহলে তো অনেক সময়ের ব্যাপার।
আপু বললেন, তা তোমরা আছ কয়জন?
আমি বললাম, ১০-১২ জনের মতো।
সবাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার?
জি আপু।
তো তোমরা ২০ জনের মতো গিয়ে কর্তৃপক্ষকে পাকড়াও করলেই তো পার। নয়তো এরা দ্রুত সমস্যাটা সমাধান করবে ভেবেছ?
হা হা হা। ঠিকই বলেছেন, আপু।
তোমরা কী করবে ভেবেছ?
আপাতত আরও এক-আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করব। এখন আবার বাসে যাওয়াটা অনেক কস্টলি হয়ে যাবে।
মঞ্জু বলল, তার ওপর আমি টিকিট কেটেছি ব্ল্যাকে।
তাহলে তো বাসে যেতে চাইলে তোমাদের এক মাসের খরচ এখানেই শেষ।
জি আপু। তাই তো অপেক্ষা করছি।
আমার কথা আর কী বলব। তাড়াহুড়ো কিছু নেই। দেরি যেহেতু হয়েছেই, এখন দেরি আরও ঘণ্টাখানেক হলেও আপত্তি নেই। রাতের ট্রেনে যাওয়ার কারণ হলো সকাল সকাল ক্যাম্পাসে পৌঁছে পুরো দিনটা রেস্ট নিয়ে বিকেলের টিউশনিটা শুরু করা। ক্লাস শুরুর আরও দিন কয়েক বাকি। আপাতত সেটা যখন আর হচ্ছে না, তাই আমার কোনো তাড়া নেই। তা ছাড়া আমি একা তো আর বসে নেই। সাথে আরও ১০ জন পরিচিত আছে। ট্রেনে যাত্রী রয়েছে প্রায় ৮০ শতাংশই। ২০ শতাংশ মাত্র ধৈর্য ও সময়ের মূল্য বিবেচনায় এত ধকলের পর পাওয়া টিকিটের মায়া ত্যাগ করতে পেরেছে। তাই আমাকে যে–ই জিজ্ঞেস করছে নেমে যাব, নাকি অপেক্ষা করব, আমি তাকেই বলছি, দেখি না আরও এক-আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করে কী হয়। কিন্তু এই এক-আধ ঘণ্টার পালা আর ফুরোবার নয়। ভাবছি, এই লাইন ধরে দিনের বাকি ট্রেনগুলোও এসে আটকা পড়ে আছে। একেবারে জাতীয় ট্রেনবিভ্রাট।
ততক্ষণে স্টেশনটা বেশ ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। যুবকদের কয়েকটা দল বসেছে কার্ড খেলায়। কী সুন্দর খোলা স্টেশনে গামছা বিছিয়ে চারজন-পাঁচজন করে বসেছে। আকাশ মেঘলা। তাই রোদের লেশমাত্র নেই। যুবকদের বাকি অংশ ফেসবুকিং ও আড্ডায় ব্যস্ত। আর বাদবাকি ঘুমে। একজন ফেসবুকে পোস্ট করেছে, ‘হঠাৎ ভোররাত চারটায় জেগে দেখি, চট্টগ্রামগামী ট্রেন কুমিল্লার কাছাকাছি গিয়ে রিভার্স সুইপ করে আবার উল্টো দিকে যাচ্ছে। তখন ভাবিনি এর খেসারত আজ সারা দিন দিতে হবে।’
আজকের এই খেসারতের দিনযাপন নিয়ে তারা অনলাইনে বেশ সরব। তবে ট্রেনভর্তি এই তরুণদের তারুণ্যই অপেক্ষারত ট্রেনযাত্রীদের এই যাত্রায় অনেকটুকু স্বস্তি এনে দিয়েছে। যাঁদের ছোট ছোট বাচ্চা আছে, তাঁরা ব্যস্ত বাচ্চা সামলানোয়। পাশের সিটের এক ভদ্রলোককে বারবার ব্যস্ত হতে দেখা যাচ্ছে। তিনি কিছুক্ষণ পরপর বলছেন, আজ দুপুর দুইটা থেকে কক্সবাজারে এক হোটেলে আমাদের ইন টাইম। দুই রাত তিন দিনের প্যাকেজ। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, তাদের ইন টাইম পার হয়ে গেলেও তিনি নেমে বাসে যাবেন না। আমাদের সঙ্গে ট্রেনেই যাবেন। মেরিন একাডেমির একদল ক্যাডেট দেখা যাচ্ছে স্টেশনজুড়ে। ঈদের ছুটি শেষে তাদের বুঝি আজ রিপোর্টিং ডে। এসব একাডেমি অনেক বেশি পাংচুয়াল হয়। কিন্তু কী আর করা! তারাও তো আর দেশের আনপাংচুয়াল সিস্টেমের বাইরে নয়। কিছু কপোত-কপোতীকে দেখা যাচ্ছে ঘটনা নিয়ে নিতান্তই ভাবলেশহীন। তারা যেন একে-অন্যের চোখে চোখ রেখেই অনায়াসে পাড়ি দিতে পারবে পুরো পথ। তাদের মুখে কী যে কথার ফুলকি! শেষ হবার নামগন্ধ নেই। কিছু যুগলের প্রেমটা এতটাই প্রবল যে তারা এতক্ষণে একবারও আসন ছেড়ে ওঠেনি। নির্মিতব্য স্টেশনটির আশপাশের সড়কের যানবাহন সামান্যই। কিন্তু এখন অটো ও সিএনজি এসে লাইন ধরেছে। হকার ও ভাসমান খাবার বিক্রেতারাও এসে ভিড় জমিয়েছে। আশপাশের চায়ের টংদোকানগুলো সবচেয়ে জমজমাট। দোকানি চা বানিয়ে কূল পাচ্ছে না। শশীদলে পরিস্থিতির শিকার একটা ট্রেনের সব যাত্রী আজ যেন তাদের সবার জন্য কাছে পাওয়া দূর আকাশের শশী। ঘাটের লক্ষ্মী। লক্ষ্মী থেকে মনে হলো, আমাদের বগিতে একটা সুশ্রী মেয়েও আছে। তার পরনের হলুদ রঙের জামাতে তাকে পুরো প্রজাপতির মতো লাগছে। ভিড়ের মাঝেও এই প্রজাপতিকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা কারও নেই। তাই তো এত কিছুর মাঝেও আমার চোখ বারবার তার দিকেই গিয়ে আটকাচ্ছে। ভ্রমণকালীন এই সব সুশ্রীর সাথে জীবনে দ্বিতীয়বার দেখা হওয়ার সম্ভাবনা যেখানে নেই বললেই চলে, সেখানে এসবের কোনো মানে হয়? কী জানি! এখন হয়তোবা হয়। এখন চাইলেই হঠাৎ পরিচয়ে কারও সাথে খাতির জমিয়ে তার ফেসবুক আইডিটা চেয়ে বসা যায়। আমি একবার জিজ্ঞেসই করে বসলাম, আপনি কি ভার্সিটি স্টুডেন্ট?
মেয়েটি তাকানোর আগে তার মা আর ছোট বোন আমার দিকে তাকাল। আমি ঠোঁটে হাসির রেখাটা একটু চওড়া করলাম। তারা আর কিছু বলল না। সে বলল, জি না। আমি কলেজে পড়ি।
ওহ আচ্ছা। আমি ভাবলাম আপনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কি না।
ওহ আচ্ছা।
আমি মনে মনে বলছি, ‘ওহ আচ্ছা’ কী? ‘ওহ আচ্ছা’ কোনো কথা হলো? এর মানে হলো আমি আর কথা বলতে চাই না। বললেই পারেন, আপনি কি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন?
আমি কী বলব, ভেবে না পেয়ে কথা এগোনোর জন্য বললাম, হুম। আপনারা কোত্থেকে আসছেন?
মেয়েটির মা জবাব দিল, ঢাকা থেকে।
যেহেতু মা জবাব দিয়েছে, আমিও ‘ওহ আচ্ছা’ বলে বুঝিয়ে দিলাম আমি আর কথা বলতে চাই না।
কিছুক্ষণ পর লক্ষ করলাম, আমার জুনিয়রদের মাঝে প্রজাপতি মেয়েটি ও তার বোনটিকে নিয়ে কথা হচ্ছে। তারা নিজেদের মধ্যে মেয়ে দুটিকে ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। একজন ঘোষণা দিচ্ছে, বড়টা আমার। ছোটটা তোর।
অপরজন সায় দিয়ে বলছে, আচ্ছা যা, মানলাম।
তাদের ভাবটা এমন যে তাদের দ্বারা মেয়ে দুটির শেষ রক্ষা হলো।
আম্মু সকাল থেকে একটু পরপরই ফোন করছে। প্রতিবার নতুন আপডেট জানতে চাচ্ছে। কিন্তু প্রতিবারই আমার একই জবাব শুনে তিনি বেশ চিন্তিত বোধ করছেন। এসবের মাঝে তপু ভাই ফোন দিয়ে আমাকে নিয়ে একহাত মজা নিয়ে নিলেন। মজা নেওয়ার বিষয়ে তার থেকে ছাড় পাওয়া মুশকিল। তিনি বললেন, কী রে, ট্রেনে গিয়ে কত টাকা সেভ করলি? বললাম, চল বাসে যাই। শুনলি না। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর। আমি কাল সকালে বাসে যাওয়ার সময় তোকে পিক করে নেব।
আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে বললাম, টাকা ভালোই সেভ হয়েছে, ভাই। যাকে বলে একেবারে বিনা খরচে বৃন্দাবন।
সিদ্দিক ভাই আজ সকালের ট্রেন ধরতেন। তার সাথে এই রুটের পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয়েছে বেশ কবার। আর বাকি সময়টা কেটেছে জুনিয়রদের সাথে আড্ডায়, হাসাহাসিতে। এর মধ্যে একবার অনলাইনে এসে দেখি, আমাদের সহযাত্রী এক ভাই গ্রুপে মেসেজ দিয়েছেন, আমি সকালেই নেমে গিয়েছিলাম। বাসায়ও চলে এসেছি এক ঘণ্টা আগে। আগামীকালের তূর্ণায় আবার যাব।
বেলা ১১টার দিকে এসে দুটি ভালো সংকট দেখা গেল। এক. প্রায় সবার মোবাইলের ব্যাটারি লো। অনেকের মোবাইল ইতিমধ্যে অফ হয়ে গেছে। ফুয়েল বাঁচাতে ট্রেন কর্তৃপক্ষ ইঞ্জিন অফ করে দিয়েছে। তাই ট্রেনে চার্জ দেওয়ার সুযোগ থাকলেও পাওয়ার সাপ্লাই নেই। দুই. ট্রেনের টয়লেটগুলোর পানি শেষ। ট্রেনের টয়লেট ব্যবহারের একটি বিশেষ নির্দেশনা হলো ট্রেন কোনো প্ল্যাটফর্মে অবস্থান করলে সেই অবস্থায় টয়লেট করা থেকে বিরত থাকা। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে এমন নির্দেশনা মেনে চলা অসম্ভব। যার ফলে পুরো প্ল্যাটফর্ম মলমূত্রের দুর্গন্ধে ভরে উঠেছে। ভোরে দেখা হওয়া চাচা মিয়াকে দেখা যাচ্ছে লোকজনকে ধরে ধরে বলাবলি করছে, গুর গন্ধে টিক্কা থাকন দায়। আল্লাহ এই আজাব থেকে রক্ষা করো।
এমন অবস্থায় বগিগুলোর মাঝখানটা হলো তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থান। অনেক যাত্রী চলে যাওয়ায় অনেক সিট ফাঁকা আছে। আমি সোজা আমাদের বগিতে এসে বসে গেলাম। ঠিক মাঝখানটায়। ক্লান্তিতে চোখ–মুখ, শরীর একেবারে ঝিমিয়ে পড়ছে। আর নড়চড় নয়। আর উঠছি না। চোখ বুজে শান্তির নিদ্রা গেলাম। ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা ১২টা ক্রস করেছে। সময়ের হিসাবে ১০ ঘণ্টা পার হয়েছে। কে জানে হয়তো ঘুম থেকে উঠে দেখব এই পুরো ব্যাপারটা একটা নিছক স্বপ্ন ছিল। পৌঁছে গেছি গন্তব্যে।
না, এটাকে আমি দুঃস্বপ্ন বলব না। এটা হলো Erratic pleasure।