ঢাকা থেকে বাড়িতে ফিরতে অনেকটা রাত হয়ে গিয়েছিল সেদিন। রাত প্রায় তিনটা-চারটা হবে। মুঠোফোনে চার্জ না থাকায় সঠিক সময় বলতে পারছি না। কোথাও থেকে এলে আমাদের নামতে হয় বাজারে। সেখান থেকে বাকি পথ হেঁটেই যেতে হয় বাড়িতে। পাঁচ-সাত মিনিটের রাস্তা। মুঠোফোন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাঁদের মৃদু আলোতেই বাড়ির দিকে পা বাড়াই। আমাদের বাড়ির পেছনে বিশাল বড় জঙ্গল। পাশে আরও দুই–তিনটা ছোট জঙ্গল আছে। রাস্তাটা একদম জঙ্গলের পাশ ঘেঁষে। রাত ৯টার পর এখানে মানুষের আনাগোনা প্রায় বন্ধই থাকে। যেহেতু তখন শেষরাত, তখন তো আর কথাই নেই। একেবারে জনশূন্য। বাতাসে বাঁশের পাতার আওয়াজ পর্যন্ত স্পষ্ট কানে বাজছে। যেহেতু ছোট থেকে এখানেই বড় হয়েছি, জঙ্গল নিয়ে কিংবা ভূত-প্রেতে খুব একটা ভয় লাগে না। স্বাভাবিকভাবেই মনের ভেতর এসব খুব একটা আসে না। কিন্তু সেদিনের ঘটনা ছিল একেবারে ভিন্ন।
জঙ্গলের পাশ কাটিয়ে যখন বাড়ির দিকে আসছিলাম, তখনই ভয়ানক বিদঘুটে একটা শব্দ শুনতে পেলাম। রাতের নির্জনতায় আওয়াজটা স্পষ্ট কানে ঢুকল। একটু থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। পরে মনে হলো, হয়তো প্যাঁচার ডাক হবে। মাথা থেকে বিষয়টা ঝেড়ে ফেলে সামনের দিকে পা বাড়ালাম। কিন্তু আবারও সেই একই আওয়াজ। ঠিক যেন আগেরটার পুনরাবৃত্তি ঘটল। সেই সঙ্গে মনে হচ্ছিল, পাশে বাঁশের ঝাড়ে যেন ঝড় উঠেছে। সঙ্গে সেই বিদঘুটে আওয়াজ কিছুটা সময় পরপর কানে আসছে ভিন্ন ভিন্ন সুরে। এবার কিছুটা ভয়ই পেলাম। অনেক কিছুই গোলমেলে লাগছিল। তা ছাড়া এখানে একটা জলপাইগাছ ছিল। দাদির কাছ থেকে শোনা, সেখানে একজন মারাও গিয়েছিল জিনের থাপ্পড় খেয়ে। তখন সেই ঘটনা মনে হতেই ভয়টা আরও বেশি করে চরাও হলো মাথার ভেতর। মনে হচ্ছিল, আমার অবস্থা অনুকূলের বাইরে চলে যাচ্ছে।
বেশির ভাগ সময় ভয় পেলে যা করি সেটা হচ্ছে, চোখ বন্ধ করে দৌড়াই কিংবা কাউকে ডাক দেই। চিৎকার করে ডাকতে গেলাম, দেখি গলা দিয়ে কোনো শব্দই বের হলো না। অন্যদিকে চোখ বন্ধ করে দৌড় দিতে যাব, কিন্তু পা আর চলে না। কেউ যেন পায়ের মধ্যে টেনে ধরে আছে। ধপ করে বসে পড়লাম রাস্তার ওপরই। তখনো চোখ বন্ধ। পুরোদমে ঘামছি। শার্ট ভিজে শরীরের সঙ্গে মিশে গেছে একেবারে। মনে মনে একের পর এক সুরা পড়ছি। কিছুক্ষণ পর মনে হলো, পায়ের শক্তি ফিরে এসেছে। কোনোরকমে উঠে দাঁড়ালাম। কোনোরকমে কয়েক কদম সামনের দিকে অগ্রসর হলাম। কিন্তু বিপদ তখনো কাটেনি, সামনে তাকিয়ে দেখি পুরো একটা বাঁশঝাড় আমার রাস্তার ওপর পড়ে আছে। যেন বাঁশগুলো শুইয়ে রেখে দিয়েছে কেউ। এবার হতবুদ্ধি হলাম পুরোপুরি। ভয় পুরোপুরি গ্রাস করেছে। থরথর করে হাত–পা কাঁপছিল। জ্ঞানশূন্য হয়ে রাস্তার ওপর কতক্ষণ পড়ে ছিলাম, জানি না।
ফজরের আজান শুনে জ্ঞান ফিরেছে। চোখ খুলে দেখি সব ঠিকঠাক। রাস্তাটা একদম পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আজানের কারণে অনেকটা সাহসেরও সঞ্চার হয়েছিল মনে। সেখান থেকে উঠে বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। মজার বিষয় হচ্ছে, যেখানে ঘটনাটা ঘটেছে, সেখান থেকে বাড়িতে যেতে এক মিনিটের পথ। জোরে ডাক দিলেও ঘর থেকে শোনা যাবে, এমন। অথচ আমি বাড়ির পাশেই ঘণ্টা দুয়েক অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিলাম। কেউ টের পায়নি। গায়ে ধুলো–মাটি মেখে একাকার অবস্থা। বাড়িতে এসে আর কাউকে কিছু বলিনি এ ব্যাপারে। সোজা লম্বা একটা ঘুম দিলাম।
অনেক দিন পর রাস্তার ওপর বাঁশের শুয়ে থাকার ব্যাপারটা আবিষ্কার করেছিলাম। সেটা মূলত বাঁশের ছায়া ছিল। মেঘে চাঁদটা ঢেকে যাওয়ায় ছায়াটা গাঢ় হয়ে গিয়েছিল সেদিন। ভয়ে সেটাকেই এমন মনে হচ্ছিল আর জঙ্গলে শব্দ হয়েই থাকে। রাতে নীরবতা থাকায় স্পষ্ট শোনা যায় সবকিছু। মাথার মধ্যে তখন অন্য কিছু ঢুকে যাওয়ায় সেটাকে অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল? নাকি আসলেই ভূত কিছু ছিল?