ভাত–মাংসের ঘ্রাণ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো শাহেন শাহর চোখে পড়ছে। বিরক্তিতে চোখ কুঁচকে পাশ ফিরল। অনেক রাত অবধি ঘুম হয়নি, খিদেয় ছটফট করেছে। কাজ নেই, কাল দুপুর থেকে শুধু পানি খেয়েছে। ঘুম ভেঙেছে কিন্তু উঠতে ইচ্ছা করছে না। পিপাসা পেয়েছে খুব। ইস্টিশনের কলটাও নষ্ট। শূন্য বোতল, পানি আনতে যেতে হবে দূরে। পেটের ভেতরে ক্ষুধার জ্বালায় চোঁ-চোঁ করছে।

ঠিক সেই সময় আকালীর ডাক, ‘গুরু ওঠো, বেলা বেড়েছে, আর কত ঘুমাবে।’

চোখ কচলে উঠে বসল শাহেন শাহ। আধছেঁড়া প্যান্টের দড়ির গিঁটটা আর একটু কষে বেঁধে নিল। পেটে খাবার নেই, ঢিলে হয়ে গেছে।

আকালী বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বলল, ‘কও তো গুরু, কী খবর আছে?’

জানিনে, ‘তুই বল।’

ওই যে মাঠের ওপাশের গ্রামে আজ বিয়ের মেজবানি, যাবে?

শুনেই শাহেন শাহর খিদে বেড়ে উঠল। দোনোমোনা করে বলল, ‘হ্যাঁ যাব, চল যাই দুজনে।’

এটা রাজশাহীর সীমান্তবর্তী ছোট্ট একটা ইস্টিশন ‘বীরকুৎসা’। ভিড় নেই, চারদিকে খোলা। মাঠের পর মাঠ ধানের আবাদ। কিছু দূর গেলেই দেখা যায় বিশাল পরিত্যক্ত হাজারদুয়ারি বীরকুৎসা রাজবাড়ী। এরপর আর একটা ইস্টিশন আছে, তার পরেই ভারতের সীমান্ত।

প্রতিদিন একটা ট্রেন যাতায়াত করে। এখানে রুটির দোকানে কাজ করে শাহেন শাহ। দোকানের মালিক আকবর আলী গরিব মানুষ। দোকানের যৎসামান্য আয় দিয়ে কোনোমতে সংসার চলে। শাহেন শাহ নাম তার দেওয়া। আকালী চায়ের দোকানে ফাইফরমাশ খাটে।

সকালে ট্রেন যাওয়ার সময় যাত্রীরা রুটি–শিঙাড়া–চা খায়, তাতেই কোনোমতে এখানকার দোকান চলে। মাত্র তিনটি দোকান। দুটিতে চা আর এটাতে রুটি–শিঙাড়া বিক্রি হয়।

বেশ কিছুদিন ট্রেন বন্ধ, তাই দোকানও বন্ধ। খাবারের খুব কষ্ট।

শাহেন শাহ শূন্য দোকানে রাতে ঘুমায়। দুদিন খাবারের কোনো জোগাড় নেই। কদিন আকবর আলী খাবার দিয়েছে, এখন আর পারছে না। তার অন্য কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা নেই। এখানে ছোট্ট ইস্টিশনের মায়া পড়ে গেছে। নিজের ঘরবাড়ি, বাবা-মা, কোনো ঠিকানা জানা নেই।

সুবোধ শান্ত চেহারা মায়াবী মুখ শাহেন শাহর। বড় বড় চোখে সারল্য গলায় মাশা আল্লাহ দারুণ সুর। আগে ট্রেনে গান গাইত, যাত্রীরা খুশি হয়ে যা দিত তাতেই চলে যেত। এই ইস্টিশনে এসে একেবারে থেকে গেছে। ভেসে বেড়াতে আর ইচ্ছা করে না। আকালীও শাহেন শাহর মতো, তারও কেউ নেই। ইস্টিশনে অন্ধ এক ভিক্ষুকের সঙ্গে ভিক্ষা করত। সে মারা যাওয়ার পরে চায়ের দোকানে কাজ নিয়েছে। দুজন প্রায় সমবয়সী, সবে কৈশোরে পা দিয়েছে।

সাতপাঁচ ভাবার সময় নেই। রংচটা গেঞ্জি, তালি দেওয়া প্যান্ট আর খালি পায়ে দুজনে হাঁটা শুরু করল। আজ খুব গরম, রোদের তেজ চড়চড় করে বেড়ে উঠছে। তাতে আবার দুদিন দুজনের পেটে দানাপানি কিচ্ছু জোটেনি।

চারদিকে সবুজ চারা ধানে মাঠ ভরে আছে। কোনো গাছ নেই। ছায়াহীন খেতের সরু আলপথ ধরে হেঁটে চলল শর্টকাট। রোদে কাদামাটি থেকে ভাপ উঠছে ভ্যাপসা গরম। পেটের খিদে তাদের তাড়িয়ে নিয়ে চলল। মনে আশা, গেলে কিছু খাবার জুটবে।

মাঠ পেরিয়ে ঘামে ক্লান্ত–শ্রান্ত দুই কিশোর মেজবানবাড়ির প্রায় কাছে এসে পৌঁছাল। দূর থেকেই ভাত আর মাংসের ঘ্রাণ নাকে ঝাপটা দিল। পেটের ভেতর রাক্ষুসে ক্ষুধাটা নড়েচড়ে জাঁকিয়ে বসল। শাহেন শাহ প্যান্টের দড়ি আর একপ্রস্থ টাইট করে নিল। দুজনের চলার গতি শ্লথ হয়ে গিয়েছিল। খাবারের ঘ্রাণ তাদের শক্তি এনে দিল। ক্ষুধার্ত দুজনের চোখাচোখি হতেই হাসি উপচে পড়ছে খুশিতে। এই খুশি–আনন্দ একমুঠ ভাত খেতে পাওয়ার আশায়।

বড় প্যান্ডেল, ভদ্র সুবেশী লোকজন খাওয়াদাওয়া করছে। হতদরিদ্র দুই কিশোর ধীর পায়ে প্যান্ডেলের গেটে গিয়ে দাঁড়াল। একজন খেঁকিয়ে উঠল, এই যা ভাগ, কোথা থেকে সব ভিখিরি এসে জুটেছে। যা ওদিকে।

দুজন দূরে এসে গাছের নিচে বসে রইল। দেখছে মানুষ খাচ্ছে। তাদের হাঁক–ডাক আর ভাত, মাংস, ডাল, মাছভাজা, দই।

ক্ষুধা আর পিপাসায় কাতর হয়ে দুজন প্রতীক্ষায় বসে রইল। তাদের দিকে কেউ ফিরেও তাকাল না।

উচ্ছিষ্ট এঁটোকাঁটা একজন ডালায় করে এনে ঢেলে দিয়ে গেল। পথের কুকুরগুলো কাড়াকাড়ি করে খাচ্ছে। শুকনো মুখে শাহেন শাহ বলল, চল আকালী ফিরে যাই। এখানে খাবার দেবে না কেউ। এতটা পথ ফিরে যেতে হবে তৃষ্ণায় কাতর আকালী বলল, আর একটু দেখি না অপেক্ষা করে! বেলা প্রায় গড়িয়ে এল।

একটা দীর্ঘ ছায়া পড়ল দুই কিশোরের গায়ে। কেউ এসেছে ওদের পেছনে। খাবারের গন্ধ ছাপিয়ে একটা অন্য মা–মা গন্ধ তাদের নাড়িয়ে দিল। পেছনে তাকিয়ে দেখল একজন মাঝবয়সী মহিলা, পরনে পুরোনো ছেঁড়া শাড়ি। আঁচলের তলে থালায় ভাত–তরকারি। হয়তো এই বাড়িতে কাজ করে। মহিলা ভাতের থালা বের করে দুজনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘খাও বাবা, আহা মুখ একদম শুকিয়ে গেছে।’

এই স্নেহের পরশটুকু পেয়ে অন্য এক তৃষ্ণা জেগে উঠল। মমতা–দরদ, অচেনা, তবু মাতৃত্বের স্নেহময় ভালোবাসায় দুজনের চোখে জল চলে এল। শাহেন শাহ বলল, মা, তুমি খাবে না।

তোমরা দুজনে ভাগ করে খাও। আমি খাব না, বাবা।

আকালী আর শাহেন শাহ পেট পুরে খেলো। মাগো গেলাম, বিদায় নিয়ে দুই কিশোর খেতের আল দিয়ে ফিরে চলল। অপরিচিত মা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল।

হঠাৎ দূরে ট্রেনের হুইসেলের শব্দ শোনা গেল, ট্রেন চলাচল আবার শুরু হয়েছে।

দুই কিশোর খুশিতে চেঁচিয়ে উঠল। বাতাসে তার উল্লাস। খেতের আলপথে দৌড়াচ্ছে দুহাত ছড়িয়ে, একরাশ সবুজের ভেতর, যেন উড়ছে...।