বাবা তোমার পরিচয়ে পরিচিত হতে আজও বড্ড গর্ববোধ করি। মানুষ যে তোমাকে কত ভালোবাসে, তা যদি তোমার পরিচয় দিই, তখন বুঝতে পারি। মানুষকে সারা জীবন নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসার ফল এটি। নিজের কথা চিন্তা না করে, মানুষের কথা চিন্তা করেছ সর্বদা। সমাজ, গ্রাম, দেশ ও দশের মঙ্গল হবে, এমন কাজ করেছ সারা জীবন। শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা এবং বড় বড় দায়িত্বও কাঁধে তুলে নিয়েছ। গ্রামের মসজিদ–মাদ্রাসাগুলোতে কল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত ছিলে সব সময়। কোনো জনপ্রতিনিধি না হয়েও, আপদে-বিপদে মানুষের পাশে থেকেছ; তোমার সে অবদান অনস্বীকার্য। সমাজে কত অযোগ্য মানুষ ক্ষমতার আসনে বসেছে, তা নিয়েও তোমার কোনো আক্ষেপ ছিল না। কত মানুষ রাতারাতি দুর্নীতি ও বাটপারি করে সম্পদের পাহাড় বানিয়ে ফেলেছে! সুদ, ঘুষ খেয়ে সমাজের অতি নগণ্য মানুষও টাকার মালিক বনে গেছে! এই সব কর্মকাণ্ড নিয়ে কোনো দিন তোমার মাথাব্যথা ছিল না।
ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে জীবনকে পরিচালনা করাই তোমার লক্ষ্য ছিল, চার সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করা ও সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা। সন্তানদের বিবেক বুদ্ধি দেশ ও জাতির কল্যাণে ব্যবহৃত হবে। সেই দায়িত্বে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সফল হয়েছে। হাজার ঝড়ঝাপটা ও প্রতিকূলতার মধ্যেও তুমি বিন্দুমাত্র পিছপা হওনি। বাবা তুমি শিক্ষিত বলেই শিক্ষার বিকল্প যে আর কিছু নেই, তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলে। শিক্ষিত মানুষ হয়েও সাদামাটা দিন অতিক্রম করে এসেছ চির দিন। মাটি ও মাটির মানুষের সঙ্গে তোমার সুসম্পর্ক সর্বদাই।
তোমার পৈতৃক নিবাস ভ্রমণে: ২০০৬ সালে আমার এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম তোমার পৈতৃক বাড়িতে। তোমরা যেখান থেকে (শ্যামগঞ্জ) ছেড়ে বাউশাম এসেছিলে। আমি বুঝমান হওয়ার পর সেটিই ছিল প্রথম যাওয়া। তুমি ওখান থেকে ছেড়ে এসেছ প্রায় ৩৫-৪০ বছর হবে। এখনো তোমার সুনাম সমুন্নত। আমাকে দেখে অনেকেই জিজ্ঞেস করছিল, তুমি আবদুল হামিদের ছেলে না? জবাবে হ্যাঁ বলায়, তারা আবার বলল, তোমার বাবার চেহারার সঙ্গে বেশ মিল আছে দেখছি! তোমাকে দেখে তোমার বাবার কথা মনে পড়ে গেল। সে ছিল এই গ্রামের স্বচ্ছ নির্ভেজাল খাঁটি সোনার মতো একজন মানুষ। যত দিন গ্রামে ছিল, তত দিন মানুষের আপদে-বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ত। পড়ালেখায় ছিলেন সবার ঊর্ধ্বে। যে ক্লাসে পড়ত, সেই ক্লাসের ছেলেদেরই প্রাইভেট পড়াত, খুব মেধাবী ছাত্র। বাদেপুঁটিকা গ্রামে এমন কোনো মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না যে কারও উপকার করেনি। গ্রামের কোনো খারাপ মানুষও তাকে মন্দ বলে না। নির্দ্বিধায় বলবে হামিদের মতো মানুষ হয় না। তার সঙ্গে দীর্ঘদিন আমি চলাফেরা করেছি। ভুল করেও বলতে পারব না যে ওর আমার প্রতি কোনো দিন মনঃক্ষুণ্ন হয়েছে।
লোকটি বলল, আমি তার টানে বেশ কয়েকবার ছুটে গিয়েছিলাম তোমাদের গ্রামে, এখানকার অনেকেই গিয়েছে। সে–ও আগে প্রায় প্রতি মাসেই আসত। অনেক দিন হয়ে গেল আসে না। ব্যস্ততা বেড়েছে, সন্তানসন্তুতি হয়েছে; বলতে গেলে এই গ্রামের চেয়েও সেখানে তার প্রভাব বেশি। যাহোক, এবার বাড়িতে চল, তোমার বাবাকে নিয়ে অনেক কথা জমে আছে, যা বলে শেষ হওয়ার নয়।
বললাম, একটু বাজারে যাচ্ছি; আপনাদের বাড়ি অবশ্যই যাব। এই বলে বিদায় নিলাম। তারপর আমার বিরাট কৌতূহল হলো গ্রামটা ভালো করে ঘুরে দেখার। যার সঙ্গেই দেখা হয়, আরে তুমি হামিদের ছেলে না? কাছে এসে জড়িয়ে ধরে বলে, তুমি ঠিক তোমার বাবার মতো হয়েছ। কেউ ভাতিজা, কেউ দাদুভাই, সবাই সবার সম্পর্ক অনুযায়ী সম্বোধন করতে লাগল। আমার বন্ধুও সঙ্গে ছিল। সে বলল, তোর বাবা তো এই গ্রামের স্বনামধন্য ব্যক্তি। দুই জায়গাতেই সমানভাবে পরিচিত।
সত্যিই, তখন বুকের ভেতরটায় নাড়া দিয়ে উঠল; গর্বে বুকটা ভরে গেল।
চিরদিন দেখেছি, আমাদের চার ভাই ও দুই বোনকে সমানভাবে স্নেহ করেছ, ভালোবেসেছ। সব সন্তান তোমার কাছে সমান। ছেলেমেয়ে উভয়কেই তুমি একই পাল্লায় ওজন করেছ। সব আবদার অনায়াসে পূরণ করেছ। নিজে কষ্ট করেছ, তবু সন্তানকে তা বুঝতে দাওনি। শত দুঃখ-কষ্টেও হাসিমুখে ছিলে সব সময়। আমি যখন আপাদের বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করি, ছয় কিলোমিটার পথ দু-এক দিন পরপরই হেঁটে চলে যেতে। আমাকেও দেখা হতো, সঙ্গে আপাকেও। পৃথিবীর সব বেদনা তুমি সহ্য করতে পার। কিন্তু সন্তানের দুঃখ-কষ্ট অসুখ-বিসুখ সহ্য করতে পার না। আমার বড় ভাই দুরারোগ্য ব্যাধিতে ছিল; আমি তখন বুঝেছি তোমার পরান পাখিটা কীভাবে চটপট করেছে, যেন দেহ আছে, প্রাণ নেই। বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর তো তুমি পাথর হয়ে গেলে। ভাই হয়ে ভাইয়ের জন্য আর্তনাদে বুকের খাঁচাটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তোমার আকণ্ঠ হাহাকার আর বোবা কান্নায় যেন প্রকৃতি বাতাস ভারী করে তুলেছিল। কেনই–বা তুলবে না বল; সন্তানের লাশ কোনো বাবা কি কাঁধে তুলে নিতে পারে? তোমাকে নিতে হয়েছিল বাবা। ডুকরে ডুকরে কেঁদে বলেছিলে, আমার চারটি সন্তান, দুই জোড়ার একটি জোড়া আজ ভেঙে গেল। এক দিন বলেছিলাম বাবা তুমি আমাদের নিয়ে এত চিন্তা কর কেন? জবাবে বললেন, যেদিন বাবা হবি, সেদিন বুঝবি, তোদের জন্য কেন এত চিন্তা করি; এই বলে মৃদু হাসে!
সত্যিই, আজ বুঝতে পারি, বাবা তুমি আমাদের জন্য কেন এত চিন্তা কর।
বাবারা এমনই হয়। পৃথিবীতে সব বাবাই একই রকম। বাবা তোমাকে কোনো বিশেষণেই বিশেষায়িত করা যাবে না। তোমার তুলনা শুধু তুমি, তুমি যে অনন্য।