পুরস্কার

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ছাকিয়া মোটা একটি বই নিয়ে বাড়িতে আসে। সে এবার চতুর্থ শ্রেণিতে উঠেছে। অভাবের তাড়নায় ঠিকমতো স্কুলে যেতে পারে না। স্কুল বন্ধ করে প্রায়ই মায়ের সঙ্গে কাজে যেতে হয়। পরের বাড়ি কাজ করে সংসার চালান মা। ছাকিয়া জন্মের দুবছরের মাথায় বাবা মারা যান। অভাব-অনটনের সংসারে কোনোরকমে চলছে তাদের জীবন। ছোট এক ভাই আছে, এখনো স্কুলে ভর্তি হয়নি।

কয়েক দিন হলো স্কুলে যেতে পারে না ছাকিয়া। স্কুলে যাওয়ার সময় হলে সহপাঠী রুপা এসে হাজির হয়, বলে চল স্কুলে যাই। ছাকিয়ার স্কুলে যেতে মন চাইলেও পারে না অভাবের তাড়নায়। কিন্তু আজ তাকে স্কুলে যেতে হবে। দুদিন পর স্কুলে অনুষ্ঠান। বিজয়ের ফুল বানাতে হবে। গত বছর এ সময় বিজয়ের ফুল বানিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল সবাইকে। হাতে সময় কম ছিল ফুল বানানোর জন্য, বেশি সময় দিতে পারেনি। তারপরও দ্বিতীয় হয়েছিল সে। সে সময় প্রতিজ্ঞা করেছিল সামনের বছর প্রথম হতেই হবে।
সে কথা দিব্যি ভুলে যায় ছাকিয়া। বিকেলে জানতে পারে, কাল থেকে স্কুলে বিজয়ের ফুল অনুষ্ঠান শুরু হবে। ছাকিয়া রাতেই কয়েকবার কাগজ কেটে কয়েকটি ফুল তৈরি করে রেখেছে, আপাকে দেখাবে। রুপা আসার পর দুজনে স্কুলের উদ্দেশে বের হয়। গিয়ে দেখে বিভিন্ন ইভেন্টের জন্য শিক্ষার্থীদের তৈরি করছেন শিক্ষকেরা। ছাকিয়াকে দেখে ববি আপা মহা খুশি। তাঁর হাতের তৈরি বিজয় ফুল দেখে আপা বলল, খুব সুন্দর হয়েছে। আদর করে কাছে টেনে নিয়ে ফুল তৈরির আরও বিভিন্ন কৌশল দেখাতে লাগলেন। সে মনোযোগ দিয়ে দেখে এবং শুনতে থাকে আপার কথা।
আজকে আপার আদরে তার মন খুব ভালো হয়ে গেল। আর আফসোস করে, কেন সে এত দিন স্কুল বন্ধ দিয়েছে। আরও ভাবে যত কষ্ট হোক, স্কুল বন্ধ দেবে না। মাকে বোঝাতে হবে লেখাপড়া শিখে বড় হতে হবে। আপার আদরে চোখে পানি এসে পড়ে। আজকের দিনটি সেরা মনে হতে লাগল।

দুদিন শেখার পর সবার পছন্দমতো বিজয় ফুল বানাতে পারে ছাকিয়া। আগামীকাল অনুষ্ঠান। উত্তেজনায় সারারাত ঘুম হয় না। অন্ধকার ঘরে মায়ের পাশে শুয়ে এপাশ–ওপাশ করতে থাকে।
উপজেলার অডিটরিয়ামভর্তি বিভিন্ন স্কুল থেকে আসা শিক্ষার্থী। তাদের সঙ্গে শিক্ষক এবং মা–বাবা এসেছেন। ছাকিয়ার মা আসেননি। তার ভয় লাগছে। আবার মনে সাহসও লাগছে, আপা আছেন যে।
একসময় বিজয়ের ফুল তৈরির প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ছাকিয়া মন দিয়ে তৈরি করতে থাকে। মাঝেমধ্যে স্যার ও আপারা আসেন দেখতে। তাঁরা কোনো কথা বলেন না। ববি আপা কিছুক্ষণ পরপরই আসেন এবং তাঁর দিকে তাকিয়ে চোখে চোখ রেখে জানিয়ে দেন ঠিক আছে।

একসময় ঘোষণা হয় অনুষ্ঠানের বিভিন্ন ইভেন্টের নাম। এবার আসে বিজয় ফুল তৈরির ইভেন্ট। ছাকিয়া চুপ করে বসে থাকে বেঞ্চের এক কোনায়। সব চিন্তাভাবনা অস্থিরতা ভেদ করে কানে ভেসে আসে প্রথম হয়েছে ছাকিয়া। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সবার দিকে। মাইকে প্রথম পুরস্কার গ্রহণ করার জন্য বারবার ডাকা হচ্ছে নাম। ববি আপা যাওয়ার জন্য ডাকছেন।
মোটা একটি বই হাতে নিয়ে বাড়ি আসে ছাকিয়া। মায়ের হাতে বইখানা দেয়। মা একনজর তাকিয়ে থাকেন বইয়ের মলাটের ওপর কালো কোট ও মোটা ফ্রেমে চশমা পরা লোকটির দিকে। পরম যত্নে হাত বোলান ছবিটির ওপর। ছাকিয়া মাকে লক্ষ করে এবং জিজ্ঞাসা করে মা তুমি এই লোকটিকে চেনো?
মা বললেন, ‘যাঁর ডাকে দেশ স্বাধীন হলো, তাঁকে চিনব না? হেয় আমাগো শেখ সাব গো শেখ সাব।’

লেখা: সদস্য, প্রথম আলো বন্ধুসভা, মুন্সিগঞ্জ