দুই প্রেমিকার দ্বন্দ্ব

প্রতীকী ছবি
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

গত রাতে আমার দ্বিতীয় প্রেমিকা চাঁদের হাসি এক্কেবারে ডাইরেক্ট আলটিমেটাম দিল যে হয় ল্যাখাল্যাখি ছাইড়বা না হয় আমাকে।

বরাবরের মতো রাতজাগা পাখিগুলো সাক্ষী ছিল এ ঘটনার। কী এক অসম লড়াই হলো এ নিয়ে! শেষে আরেক প্রেমিকা মানে সাহিত্য হেরে গেল। যাকে নিয়ে এই দ্বন্দ্ব তিনি চাঁদের হাসির দিকে গড়ে গেলেন। তার সব দাবি-দাওয়া মেনে নিলেন। পাখিগুলো এর আগে সোয়ামির অপেক্ষায় থেকে থেকে বিরক্ত হয়ে ঝগড়াটে এক মহিলার আগুনঝরা কথামালা শুনত। কিন্তু এই প্রথম তারা শুনল আলটিমেটাম ও আরেক প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর শোচনীয় পরাজয়।

সাহিত্য ভান করে আমাকে বলছে, শুনেছি দ্বিতীয় বা ছোট্ট বউয়ের প্রতি নাকি সোয়ামিদের টান থাকে ব্যাশি। তুমি তাই করলে মীম মিজান! তুমি পারলে এটা করতে! আমি তোমার প্রথম প্রেমিকা বা বউ। এত দিন ধরে সংসার করে তার এই প্রতিদান দিলে! যদিও না হয়ে থাকে আমাদের তিন কবুল। তবু তো এত দিন ধরে কী দুঃখ-সুখের প্রেম-সংসার ছিল।

চাঁদের হাসি বলে উঠলেন, ওই কুটনি সতিন আমার, তুই কবে থাইক্যা রে আমার সোয়ামির ঘর করিস? আমি সেই ২০০৭ সালের ২০ এপ্রিল থেকে মন দেয়া-নেয়া করে ২০০৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বরে তিন কবুল বইল্লা আজ পর্যন্ত দুইখান ছাওয়ালের ঘ্যানর–ঘ্যানর, প্যানর–প্যানর সহ্য করে যাচ্ছি। তুই দুই দিনের বৈরাগী আমার সোয়ামির মাথাটা খারাপ কইরা ফ্যালছোস! তুই কালনাগিনী! রাক্ষসী! সর্বনাশী! তোর জন্যই সংসারের আজ এই হাল! সোয়ামিটা মোর বাউলা হয়্যা গ্যাইছে।

তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন সাহিত্য। ওই, কী কছ তুই! আমি দুই দিনের বৈরাগী? তুই তো দেখি ঢ্যামনি কিছুই জানস না। ওই তোর ভাতারকে জিগা দেহি, কাকে আগে মন দিছে? কারে আগে পিরিতের কথা কইছে?

আমার দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙিয়ে চাঁদের হাসির জিজ্ঞেস। ওই ঢ্যামনা পাগলা, দে, উত্তর দে!

আমি কিন্তু আগেই সারেন্ডার করলাম। আমার কিন্তু কোনোই দোষ নাইক্কা। আমি যখন ছোট্টবেলা ন্যাংটা ছিলাম। তখন দ্যাখতাম আমার দাদা মানে মোজাম্মেল হক দাড়িয়া ওরফে মোজা দাড়িয়া প্রত্যেক রাইতে খানাপিনার পর পুঁথি নিয়া বসত। আর গ্রামের সকল মাইয়া মাইনষে গোল কইরা দাদার চারদিকে বইস্যা ধ্যান দিয়া দেলদার কুমার, রহিম-রূপবানের কাহিনি হুনত। আমিও মায়ের কোলে থাইক্কা হুনতাম। সেখান থাইকাই কবিতাকে ভালোবাসা শুরু হরি। এরপর গল্প ইত্যাদি মানে সাহিত্যকেই ভালোবাসা শুরু হরি। যখন মুই হাইস্কুলে পড়তাম তখন একখানা সাপ্তাহিক পত্রিকার শিশুদের পাতায় ছড়া লেইখ্যা পাঠাই ছেলাম। ওরা ছাপছিল। সেইটাই ছিল সাহিত্যের প্রতি মোর প্রত্থম বালোবাসা। এহন তুমিই কও, আমি কার লগে আগে পিরিতি হরছি?

ওরে লুচ্ছা পোলা! তুই সেই ন্যাংটা কাল থাইক্কা হ্যার লগে টাংকি মারতাছ। আর বড় হইয়া আমার লগে আলগা পিরিত মারতাছ। আইজ আর তোর রেহাই নাই। হয় ওরে রাখবি না হয় কান ধইরা ওঠবস কইরা আমার কাছে আইবি? শেষ কথা ছিল চাঁদের হাসির।

আমি একবার চাঁদের হাসির দিকে তাকাই, আরেকবার সাহিত্যের দিকে তাকাই। অবশেষে বললাম, শোনো ছোট্টকালের প্রেমিকা সাহিত্য, আমারে তুমি মাফ কইরা দ্যাও। আমি আর তোমার লগে প্রেম চালাইতে পারুম না। ভুল–বেয়াদবি যা হইছে তা মাফ কইরা দিও। আর দ্যাহো না আমার দুইখান পোলা। এদের মুখের দিকে তাকাইয়া তো অত্যন্ত তোমায় ছাড়া উচিত।

এবার ঝরঝরে অশ্রুর বন্যা ভাসিয়ে সাহিত্যের ভাঙা গলায় উত্তর। হু হু হু। তুমি এত নিষ্ঠুর! এত মিথ্যাবাদী! সেই ছোট্টকাল থাইক্যা আমাদের সংসারে রাইত, নিশিরাইত, সকাল, বিকালের মিলন-ভালোবাসায় কত্ত কত্ত বীজ বুনেছ, তুমি কি তা জানো? খুব অল্পদিনের ব্যবধানে তোমার সেই বীজ থেকে কমপক্ষে পনেরোটি গাছের জন্ম হবে। এগুলোর নাম কী দিমু? হ্যাগো নিয়া আমি কার কাছে যামু? এগুলোর পিতৃপরিচয় কী দিমু?

এবার পড়ে গেলাম মাইনকা চিপায়। আসলেই তো সাহিত্যের সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে কত্ত যে প্রেম-মিলন ঘটিয়েছি তার হিসাব করতে পারব না। অনেক রাত গেছে শীতকালের উষ্ণ কম্বল ছেড়ে শিশিরভেজা ধানখেতের আল ধরে হেঁটেছি একটি উপমা নেওয়ার জন্য। মাকড়সার জালে জড়িয়ে থাকা শীতে জবুথবু শিকার হওয়া কীটের আর্তনাদ দেখেছি টর্চের আলো জ্বেলে। বিলের আলে কান পেতে শুনেছি মাটিগর্ভে মোয়া মাছের গুঞ্জরন। এজিবি কলোনির ছাদে উঠে বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে দেখেছি পরিত্যক্ত মারাত্মক হুমকির বিল্ডিংয়ের খোঁড়লে নতুন দিনের প্রত্যাশায় বাসরত গাদাগাদি কত্ত নারী-পুরুষ। আবার তুমুল বজ্রপাতের ভেতর ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম সে সময়কার পরিবেশের ভয় উপলব্ধির জন্য। সঙ্গমরত টিকটিকির দিকে তাকিয়ে ছিলাম অনিমেষ। কেমন করে প্রেম বিনিময় করে তা বোঝার জন্য। তাহলে সেই সাহিত্যকে কীভাবে পারি ছাড়তে। যার এত স্মৃতি তাকে কি পারব ভুলে থাকতে?

তবু সাহিত্যকে ছেড়ে বেছে নিলাম চাঁদের হাসিকে। সাহিত্যের অদম্য প্রেমকে নিষ্ঠুর হাতে বাতায়ন দিয়ে ছুড়ে মেরে থাই গ্লাস আটকালাম। আর ওদিকে ভ্রুক্ষেপ করিনি। হাসি খুউব খুশি হলো। হেমন্তের সামান্য শীতে পরস্পরের ওম মেখে ঘুমোচ্ছিলাম। ক্রন্দসী এক ললনা এলোকেশে মুখ ঢেকে স্বপ্নে হাজির। কারবালার আহাজারির মতো বলছে, তুমি ঘুম থেকে উঠে কার্নিশে দেখবে জোড়া বুলবুলি পাখি। চমক দেয়া থাইগ্লাসের অপজিটে বারবার ঠোকর মারবে। দুজনে বসে গলাগলিতে ব্যস্ত থাকবে। কী করে থাকতে পারবে তাদের এমন দৃশ্যের বর্ণনা না লিখে? আবার যখন কাপড় শুকোতে ছাদে যাবে। দেখবে আকাশকে কী মনোহরা করে সাজিয়েছে বহুরূপী মেঘ। পারবে কি তাদের নিয়ে না ভেবে থাকতে?

পণ্ডিতি করার জন্য পাঠশালার পথে দেখবে একজন শ্রমিকের গা থেকে পড়ছে দরদরে ঘাম। অথচ তারই টাকা মেরে মালিক থাইল্যান্ডের পাতায়ায় গণিকার ঊরুতে মুখ বুজে সুখ খোঁজে। বা তার নামে বরাদ্দ টাকায় আলিশান বাড়ি বানায় বিভূমে। এসব নিপীড়িত মানুষের দুঃখ কি তোমাকে ভাবাবে না? দ্রোহ করতে কি কলম তুলতে প্রেষণা জাগাবে না?

না, না, আমাকে একটুও ভাবাবে না। আমি ওসব ভুলে থাকতে চাই। খবরদার কালনাগিনী সাহিত্য আমাকে আর জ্বালাতে আসবি না। তোকে ভুলে থাকতে চাই। ঘুমেই জোরে জোরে বলছিলাম।

হাসি আমাকে মৃদু ধাক্কা মেরে বলছে, মীম, কী হয়েছে তোমার? এভাবে চিৎকার করতেছ ক্যানো? তুমি কি কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছিলে?

ধড়ফড় করে উঠে বসে পড়ি বিছানায়। হাপর দিয়ে কে যেন বাড়ি মারছে কলিজায়। কাঁপছি। চোখ যেন ছুটে যাবে। বিছানার দুপ্রান্তে দুপুত্র বেঘোরে ঘুমোচ্ছে।

আমি ঘেমেনেয়ে একাকার। হাসি ওড়না দিয়ে কপাল ও মুখ মুছে দিয়ে মশারি সরিয়ে বিছানা থেকে নেমে ফ্যানের সুইচ অন করল। এক মগ পানি এনে খাইয়ে দিচ্ছে আর বলছে, গলাটা বোধ হয় শুকিয়ে গেছে তোমার। আমি যতই ওই সতিনকে তাড়াতে চাই, সে কি আর পিছু ছাড়বে?