ট্রেন ছাড়তে তখনো কিছুটা দেরি…
দুপুরের দিকে ট্রেনের ভিড় কিছুটা কম। ব্যাগটিকে সামনের সিটে রেখে জানালার পাশাপাশি সিটে বসলাম। আকাশে ঘনকালো মেঘ। একটু আগেও বৃষ্টি হয়েছে, এখন টিপটিপ পড়ছে।
—আহহহহ! বুক ভরে একটা শ্বাস নিলাম। বৃষ্টির নিজস্ব গন্ধ আছে। মনটা হালকা ভালো লাগার আবেশে ছুঁয়ে গেল। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করলাম। বর্তমান দুনিয়ায় এর চেয়ে ভালো সময় কাটানোর মতো বন্ধু হয়তো আর নেই।
—ব্যাগটা একটু সরাবেন?
এক মহিলার কণ্ঠস্বরে ফেসবুকের ঘোর কাটে। সামনের সিট থেকে ব্যাগটা তুলে নিজের পাশে রাখলাম। দুটি বাচ্চা নিয়ে এক দম্পতি, সঙ্গে বেশ কিছু লটবহর, দেখেই মনে হচ্ছে বেশ লম্বা ছুটিতে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে। মহিলার চোখে চোখ পড়তেই অবাক হলাম! নিশিতা না?
নিশিতা চৌধুরী, ফার্স্ট ইয়ারে বাংলা অনার্সের সবচেয়ে হাসিখুশি ও প্রাণবন্ত মেয়ে। সুন্দরী না হলেও একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে চেহারায়। চোখে গভীর দৃষ্টি, যা ওকে পাঁচজনের ভিড়েও আলাদা করে রাখত।
আমি গ্রাম থেকে প্রথমবার শহরে এসেছি। শহরের চাকচিক্যের কাছে নিজেকে বড্ড মলিন লাগত। যতটা পারতাম, এড়িয়ে চলতাম ওদের, বিশেষ করে মেয়েদের। ভার্সিটির ক্যানটিন কালচারে অতটা অভ্যস্ত হইনি তখনো। বাড়ি থেকে মা রুটি-পরোটা করে দিত আর সঙ্গে আলু ভাজা, সুজির হালুয়া। ওতেই সারা দিনের জন্য পেট ভরাতাম।
—ইশ্! পরোটা এনেছিস? আমার দারুণ ফেবারিট। বলেই আমার টিফিন বক্স থেকে একটা পরোটা নিয়ে খেতে শুরু করে।
—হালুয়াটা তো দারুণ খেতে। এই কোন হোটেলের রে? দারুণ বানিয়েছে…
উত্তর দেব কি…আমি তো পুরো ঘটনায় থতমত খেয়ে হাঁ হয়ে আছি! কোনোরকমে মুখের খাবার গিলে আমতা–আমতা করে বললাম, ‘আমার মা বানিয়েছে এটা।’
—আন্টি? নিজে বানিয়েছেন? ওনার হাতের রান্না ভীষণ খেতে না রে? কাল থেকে আন্টিকে বলবি আমার জন্যও পরোটা আর হালুয়া একটু বেশি করে দিতে! উফ, ক্যানটিনের শিঙাড়া, ডাল, পরোটা আর নিমকি খেতে খেতে না জিবে চড়া পড়ে গেছে।
সেই থেকে নিশিতার সঙ্গে আলাপ। কখন যে কাছের বন্ধু হয়ে গিয়েছিল বুঝতেই পারিনি! ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে চলে যাবে, আর স্যারের নোট তাকে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল আমার! ওর কাছে পড়াশোনাটা, করতে হয় তাই করা। আমার কাছে ছিল ভালো রেজাল্ট আর একটা ভালো চাকরি! লক্ষ্যটা নিশিতা জানত, তাই ওদের উচ্ছলতায় কখনোই আমাকে সঙ্গী করতে চায়নি। একদিন ইতিহাসের নোটের খাতায় আমার একটি লেখা কবিতা পেয়ে গিয়েছিল নিশিতা। হা হা! তারপর মেয়ের কি অভিমান…কেন ওকে বলিনি যে আমিও কবিতা লিখি!
মহাবিপদ! তারপর কবিতা লিখে সবার আগে তাকে পড়াব—এ শর্তে রাগ ভেঙেছিল মেয়ের!
একটা-দুটো করে যেন নিমেষেই কেটে গেল অনেকটা বছর…
গ্রামের বোকা ছেলেটা এখন শহুরে কালচারে অভ্যস্ত হয়ে গেছে! এর মধ্যে রেজাল্ট পাবলিশড হলো। মনমতো রেজাল্ট পাওয়ার পরই এবার একটা চাকরির সন্ধান। নিশিতাও কোনো রকমে পাস করে গেছে…ও তাতেই খুশি! ভবিষ্যতের কোনো ভাবনা ওর নেই।
হাসতে হাসতে জবাব দেয় সে, এবার বিয়ে করে মন দিয়ে সংসার করব!
সেদিন ওর কথায় প্রথমবার বুকটা মুচড়ে ওঠে। অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমাতে পারিনি। তবে কি ভালোবেসে ফেলেছি নিশিতাকে? ভাবতেও যেন কিছুটা লজ্জা পেয়েছিলাম। বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখতে না পারার জন্য নিজেকে খুব ছোট মনে হয়!
পরদিন ভার্সিটির ক্যাম্পাসে বন্ধুরা মিলে একটা কনসার্টে অংশ নেওয়ার কথা। বিকেল চারটায় সবাই একত্র হলাম! ভবিষ্যৎ জীবনে হারিয়ে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো একসঙ্গে হয়েছিলাম সেদিন। কনসার্ট শেষে যখন বের হলাম, বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি! একে একে সবাই চলে গেল যে যার বাড়ির দিকে। বাসের জন্য অপেক্ষায় আমি আর নিশিতা! যার বাস আগে আসবে, সে আগে চলে যাবে। একই ছাতার নিচে আমরা দুজন দাঁড়িয়ে। না চাইলেও ছুঁয়ে যাচ্ছে দুজনের শরীর! নিশ্বাসে পাচ্ছি দামি পারফিউমের গন্ধ। খুব ইচ্ছা করছিল মনের কথা সব বলে ফেলি নিশিতা! কিন্তু কোথাও যেন সবকিছু আটকে যাচ্ছিল! আচ্ছা আমার হৃদয়ের অস্থিরতা কি সেদিন বুঝেছিল নিশিতা?
—আমাকে কিছু বলবি?
নিশিতার কথায় যেন আমি চেতনার জগতে ফিরি!
—কিরে…এমন হয়ে আছিস কেন! কিছু বলবি?
নিশিতার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে ভাবছিলাম, ‘তোর কি কিছুই বলার নেই আমাকে?’ আমিও আর পারলাম না! বলতে চেয়েছিলাম অনেক কিছু, তবু মুখ ফুটে একটা কথাও বের হয়নি!
ততক্ষণে এসে গিয়েছিল নিশিতার বাস! বাসে উঠতে গিয়ে শেষবারের মতো পেছনে ফিরে তাকাল সে।
বৃষ্টির জলে, নাকি চোখের জলে সবকিছু কেমন যেন আবছা হয়ে আসছে…
ছোট মেয়েটার বয়স সম্ভবত বছর দুয়েক হবে! আর ছেলেটার সাত–আট বছর। মেয়েটাকে কোলে নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে নিশিতা। মাঝে অবশ্য ১০-১১ বছর কেটে গেছে। তাই বলে ও কি চিনতে পারেনি আমাকে! নাকি ইচ্ছা করেই এড়িয়ে যাচ্ছে!
কথা বলতে গিয়েও সাহস হলো না। অপমানের ভয়ে না, ওর স্বামী যদি ব্যাপারটা অন্যভাবে নেয়, সেই ভেবে চুপ থাকলাম! একটাবারের জন্যও নিশিতা ভেতরে দৃষ্টি ফেরাচ্ছে না!
এদিকে বাইরে কালো মেঘের ঘনঘটা। প্রকৃতির কেমন যেন একটা থমথমে ভাব। মেঘ সরিয়ে সোনালি রোদে চারপাশ ভরে উঠবে, নাকি বৃষ্টি উৎসবের ধুম লাগবে, প্রকৃতির সেই ভাব বোঝার সাধ্য যেমন নেই, ঠিক তেমনি জানালার ধার ঘেঁষে বসা অভিমানী নিশিতার নির্লিপ্ত দৃষ্টি দেখেও বোঝার কোনো উপায় নেই তার মনের কোণের একান্ত গভীরতা।
আচ্ছা, নিশিতা কি তাহলে অভিমান করেছে আমার ওপর...নাকি অভিনয়?
লেখকের ঠিকানা: মালিবাগ, ঢাকা