টেলিভিশন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা
বর্তমান তরুণ প্রজন্মের স্বপ্নের জায়গা টেলিভিশন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা। অনেকেই উপস্থাপনায় ক্যারিয়ার গড়ার কথা ভাবছেন। মূলত তাঁদের জন্যই এই লেখা।
শুদ্ধ উচ্চারণ, সাবলীল বাচনভঙ্গি, আত্মবিশ্বাস—এগুলো উপস্থাপনার মৌলিক বিষয়, যা ছাড়া উপস্থাপনা সম্ভব নয়।
মনে রাখতে হবে, একজন উপস্থাপকের কাজ হলো টু ইনফর্ম, টু এডুকেট, টু এন্টারটেইন।
উপস্থাপনায় দেশসেরা কয়েকজন প্রশিক্ষকের পরামর্শ ও নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে ভালো উপস্থাপনায় করণীয় কিছু বিষয় তুলে ধরা হলো।
শুদ্ধ উচ্চারণ: একজন উপস্থাপকের শুদ্ধভাবে একেকটি শব্দ উচ্চারণ করা বাঞ্ছনীয়। আমরা প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক শব্দ ভুল বলি। অথচ ভাবি সঠিক বলছি।
সাবলীল বাচনভঙ্গি: যা-ই বলব, সেটা যেন সাবলীল হয়। কথায় যেন কোনো জড়তা না থাকে।
আত্মবিশ্বাস: এটা অতীব জরুরি। যা-ই বলি না কেন, সেটা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে হবে। তাহলে উপস্থাপনা প্রাণবন্ত হবে।
সাম্প্রতিক জ্ঞান: একজন উপস্থাপকের সাম্প্রতিক ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কিত আনুষঙ্গিক জ্ঞান থাকা জরুরি। না হলে উপস্থাপনা মানসম্পন্ন হবে না।
উপস্থিত বুদ্ধি: অবশ্যই একজন ভালো উপস্থাপক হতে হলে তাঁর উপস্থিত বুদ্ধি থাকতে হবে। তাৎক্ষণিক যেকোনো বিষয়ে কথা বলার ক্ষমতা থাকতে হবে।
সময়জ্ঞান: অনুষ্ঠানের সময় কতটুকু? এর মধ্যে কী কী বলা যেতে পারে, কতটা সময় সে ক্ষেত্রে ব্যয় হবে, অতিথিকে কতটা সময় দেব, সে বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে। অনুষ্ঠান শুরুর আগে অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছানো উচিত। তাতে পরিবেশ ও অতিথি সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়।
পরিমিতিবোধ: অতিরিক্ত প্রশংসা না করাই ভালো। সামগ্রিক বিষয়ে একটা পরিমিতিবোধ থাকতে হবে।
হিউমার: একজন উপস্থাপকের ‘সেন্স অব হিউমার’ বা হাস্যকৌতুকবোধ থাকাটা জরুরি।
ব্যক্তিত্ব: ব্যক্তিত্ব খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আমি যে অনুষ্ঠানটিই উপস্থাপনা করছি, সেটার সঙ্গে আমার ব্যক্তিত্ব সাদৃশ্যপূর্ণ কি না, তা খেয়াল রাখতে হবে।
সংক্ষিপ্ততা: অল্প শব্দে বেশি কথা বলতে হবে। অর্থাৎ বক্তব্য যেন অর্থবহ হয়।
উপস্থাপককে হতে হবে নিরপেক্ষ: ধরি, এমন একজনের সাক্ষাৎকার নিচ্ছি, যাঁকে আমি পছন্দ করি না। কিন্তু আমার আচরণে যেন সেটা প্রকাশ না পায়।
স্বতঃস্ফূর্ততা: উপস্থাপককে স্বতঃস্ফূর্ত থাকতে হবে। যা বলছি, সেটা চূড়ান্তভাবে বিশ্বাস করতে হবে।
উপস্থাপক একটি চরিত্র: একজন উপস্থাপককে অনেক বড় অভিনেতা হতে হয়। তবে দর্শক যেন সেটা ধরতে না পারেন। তাঁকে অনেক সুকৌশলী হতে হবে। জীবনবোধ ও বোধশক্তি অনেক বেশি তীব্র থাকলেই চরিত্রটি নিজের মধ্যে ধারণ করা সম্ভব।
জানার আগ্রহ: উপস্থাপককে তথ্যভান্ডার হতে হবে, যাতে প্রয়োজনে উপযুক্ত তথ্য ডেলিভারি দিতে পারেন।
এগুলো হলো উপস্থাপকের যোগ্যতা।
একজন ভালো টেলিভিশন উপস্থাপক হয়ে ওঠার জন্য আরও যে বিষয়গুলো সম্পর্কে অবগত থাকা প্রয়োজন—
পরিকল্পনা: আমি কী করব, কীভাবে করব? কী ধরনের অনুষ্ঠান? আমার দর্শক কারা? আমার অতিথি কারা? সব বিষয়ে জেনে সে অনুযায়ী পরিকল্পনা করতে হবে।
অনুশীলন: অনুশীলনের কোনো বিকল্প নেই। যে–সম্পর্কিত অনুষ্ঠান, সে বিষয়ে অবশ্যই পড়াশোনা করতে হবে। যদি কোনো বিষয়ে টক শো হয় বা কোনো বিশেষ ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিতে হয়, তবে আগে অবশ্যই খুঁটিনাটি সব বিষয় জেনে যাওয়া আবশ্যক। তাতে প্রশ্ন করতেও যেমন সুবিধা হয়, তেমনি অতিথিও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
অনুষ্ঠানটি ভিজ্যুয়ালাইজ করা: নিজে নিজে চোখ বন্ধ করে পুরো অনুষ্ঠানটি কল্পনা করতে হবে। কী হতে পারে, নতুন কী করা যেতে পারে—সব ঠিক করতে হবে।
মাইক্রোফোন ব্যবহার: মাইক্রোফোনের সঠিক ব্যবহার জানা দরকার। সেটি লিপটাস কি না। ক্লিপ মাইক্রোফোন হলে কোন সাইডে লাগালে আওয়াজ ভালো আসবে। চুল ক্লিপ মাইক্রোফোনে লাগলে একটা নয়েজ হয়, সেটা খেয়াল রাখতে হবে। বুম কীভাবে ধরলে পুরো মুখ দেখা যাবে, আবার শব্দও শোনা যাবে, সেই নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
চোখের ব্যবহার: চোখের ব্যায়াম করতে হবে। চোখ যেন বেশি পিটপিট না করে। চোখ যে মনের কথা বলে। চোখের কাজ খুব জরুরি। যিনি আপনার অতিথি কিংবা ক্যামেরায় দর্শকের উদ্দেশে কিছু বলছেন। তখন যেন আই কন্টাক্ট ঠিক থাকে, সেটা মাথায় রাখতে হবে।
বলিষ্ঠ প্রক্ষেপণ: স্বরের প্রক্ষেপণ যেন বলিষ্ঠ হয়।
দেহভঙ্গি: অযথা হাত নাড়া, জিব দিয়ে ঠোঁট ভেজানো—এগুলো করা যাবে না।
প্রয়োজনীয় বিরতি: একটি বাক্য বলার সময় কোন শব্দের পরে একটু থামলে ভালো শোনাবে, সেটা খেয়াল রাখতে হবে।
কণ্ঠের ওঠানামা: এক টোনে কথা বললে শ্রুতিমধুর লাগে না। তাই চাই কণ্ঠের ওঠানামা।
বাচনভঙ্গি: বাচনভঙ্গি সুন্দর হওয়া বাঞ্ছনীয়।
পোশাক ও সাজসজ্জা: বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে যদি কালো রঙের পোশাক পরি, তাহলে সেটা দৃষ্টিকটু দেখাবে। সর্বোপরি সাজ যেন নান্দনিক হয়।
বাহুল্য শব্দ ব্যবহার না করা: কথা বলার সময় আ, উ ইত্যাদি বাহুল্য শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। সুন্দরভাবে গুছিয়ে কথা বলতে হবে।
ধারাবাহিকতা: কথার ধারাবাহিকতা যেন বজায় থাকে। যে বিষয়ে কথা হচ্ছে বা যেই বিষয়ক অনুষ্ঠান, তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কোনো কথা বলে অনুষ্ঠান শেষ করা ভালো।
টেলিভিশনে ‘অন এয়ার চার্ম’ বলে একটি কথা আছে। এর আওতায় যে বিষয়গুলো আছে—
১. দৃষ্টি
২. পোশাক
৩. সাজসজ্জা
৪. বাচনভঙ্গি
৫. তথ্য
৬. পরিশুদ্ধ ভাষা
৭. কণ্ঠ
৮. সার্বিক সৌন্দর্য
৯. ব্যক্তিত্ব
একজন ভালো উপস্থাপক হতে হলে অনেক বেশি জানতে হবে, অনেক চর্চা করতে হবে। তবে কাউকে অনুকরণ না করে অনুসরণ করাই ভালো।
মৌসুমী মৌ: উপস্থাপক ও অভিনয়শিল্পী। সাধারণ সম্পাদক, প্রথম আলো বন্ধুসভা।