চিরুনি

প্রতীকী ছবি
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আমার মাঝেমধ্যে শাহ আলম স্যারের কথা মনে পড়ে। স্যার আজ আর বেচে নেই। আমি তাঁর গল্প লিখতে বসেছি। আচ্ছা, আমি যখন থাকব না, তখন কেউ কি আমাকে নিয়ে কিছু লিখবে? অবশ্য কেউ কিছু লিখুক বা না লিখুক, আমার তাতে কিছু যাবে আসবে না। তখনো পৃথিবীতে কাঁচা মরিচ থাকবে, প্লেটে গরম ভাত সাজানো হবে, কেউ সেটি দেখে আমার মতোই বলবে, ভাতের ফুল!

বেদনার কথা থাক। কারণ, কবি বলেছেন, ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!’ শাহ আলম স্যারের কথা বলি। আমরা তখন ফোর থেকে ক্লাস ফাইভে উঠেছি। পুরোনো বই নিয়ে ক্লাসে যাই। যেকোনো দিন নতুন বই পাব। আমাদের মধ্যে তাই চাপা উত্তেজনা। আমাদের ক্লাসের টুক্কু মাসুদ প্রায়ই খবর নিয়ে আসে, আজ নতুন বই দেবে। কিন্তু দেয় না। টুক্কু মাসুদটা এমনই, কোনো একটা কথা বলে আমাদের ব্যস্ত রাখে। ক্লাসে মাসুদ দুজন, এই মাসুদ সাইজে একটু ছোট হওয়ায় আমরা তাকে টুক্কু মাসুদ ডাকি। যা–ই হোক, নতুন ক্লাস আর নতুন বইয়ের উত্তেজনা ছাপিয়ে এক নতুন স্যার স্কুলে জয়েন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠলেন। টুক্কু মাসুদ খবর নিয়ে এল, নতুন স্যার নাকি খুব কড়া, নাম শাহ আলম এবং শাহ আলম স্যার নাকি আমাদের বিজ্ঞান ক্লাস নেবেন। আমরা টুক্কু মাসুদের কথা তেমন একটা পাত্তা দিলাম না।

শাহ আলম স্যারের ব্যাপারে আরও অনেক উড়া উড়া খবর পেতে লাগলাম। তিনি নাকি গরু পিটিয়ে মানুষ বানাতে পারেন। তাঁর আগের স্কুলের নাম ছিল ইস্পাহানি স্কুল। তিনি ছিলেন সেই স্কুলের ত্রাস। সেখানে তিনি প্রচুর গরুকে মানুষ বানিয়েছেন। আমরা তখনো স্যারকে কাছ থেকে দেখিনি। লুকিয়ে লুকিয়ে দূর থেকে দেখি। আমাদের মধ্যে এই একটি ব্যাপার ছিল, স্কুলের বাইরে কোনো স্যারকে দেখলে দৌড়ে পালিয়ে যেতাম, এর কী কারণ কে জানে।

শাহ আলম স্যারের ছিল মুখভর্তি বসন্তের দাগ। তবে সেই দাগ খুব বেশি স্পষ্ট নয়। স্যারের বড় গোল মুখে সেটি খুব মানিয়ে গেছে। শেষমেশ টুক্কু মাসুদের কথাই সত্য হলো। এক সকালে একটা জালিবেত নিয়ে শাহ আলম স্যার আমাদের ক্লাসে হাজির হলেন। জালিবেত এক বিশেষ ধরনের বেত। এই বেত দিয়ে তখন পড়া না পারলে আমাদের বানানো হতো। টুক্কু মাসুদ আমাদের বলেছে, জালিবেত দিয়ে মারার সময় শরীর শক্ত করে রাখবি না, শরীর স্বাভাবিক রাখবি, তাহলে ব্যথা কম পাবি। যারা পড়া শিখে আসত না, তাদের এসব পরামর্শ খুব কাজে লাগত।

শাহ আলম স্যার ক্লাসে ঢুকে চেয়ারে বসলেন। খুব আলতো করে জালিবেত টেবিলের একপাশে শুইয়ে রাখলেন। টুক্কু মাসুদ ‘কি বলেছিলাম না’—এ রকম এক অভিব্যক্তি নিয়ে হাসিমুখে এর-ওর দিকে তাকাচ্ছে।

স্যার বললেন, ‘কী অবস্থা তোদের?’

আমরা চুপ করে রইলাম। স্যারের ভরাট কণ্ঠস্বর একটি ভারী মেঘের গর্জনের মতো আমাদের ক্লাসের আকাশের একপাশ থেকে আরেক পাশে চলে গেল। আমি আড়চোখে দেখলাম, টুক্কু মাসুদের মুখও শুকিয়ে গেছে।

বল, চিরুনি না ফারুনি? প্রশ্ন করলেন স্যার।

এবার আমরা কিছুটা স্বাভাবিক হলাম। আমরা একদল স্যারের প্রশ্নের উত্তর দিলাম। আমরা বললাম—

স্যার চিরুনি।

স্যার এবার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। আমরা যারা চিরুনি বলেছি, তাদের সবার কাছে এসে হাত পাততে বলে একটা করে বেতের বাড়ি দিলেন। আমি জালিবেতের বাড়ি খাওয়ার সময় টুক্কু মাসুদের পরামর্শ অনুযায়ী হাত স্বাভাবিক রাখলাম, খুব একটা কাজে লাগল না। কেউ কেউ জালিবেতের বাড়ি খাওয়ার সময় নাচের মতো একটা মুদ্রা করতে লাগল। যারা স্যারের প্রশ্নের উত্তরে চিরুনি বলেনি, তাদের মধ্যে একটা স্বস্থির আভাস দেখা গেল। আগ বাড়িয়ে উত্তর দিয়ে বিপদ ডেকে আনায় আমার তখন নিজের ওপর রাগ হতে লাগল।

স্যার আবার চেয়ারে গিয়ে বসলেন। পুরো ক্লাসে পিনপতন নীরবতা। স্যার বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে আবার প্রশ্ন করলেন—

বল, চিরুনি না ফারুনি?

এবার আগে যারা উত্তর দেয়নি, তারা খুশি হয়ে উঠল। কারণ, এ রহস্যময় প্রশ্নের উত্তর যেহেতু চিরুনি না, তাহলে ফারুনিই সঠিক উত্তর। কারণ, অপশন এখন এটিই। তাই বাকিরা বলে উঠল—

স্যার ফারুনি। ফারুনি দলে টুক্কু মাসুদকেও দেখলাম।

উত্তর শুনে স্যার বললেন, ‘কারা কারা ফারুনি বলেছিস, দাঁড়া।’

ফারুনি দল দাঁড়াল।

জালিবেতের বাড়ি তাদের জন্যও বরাদ্দ হলো।

স্যার আবার চেয়ারে বসলেন। পুরো ক্লাস হতবাক, হতাশ হয়ে বসে আছে।

স্যার আবার বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছেন। একটু থেমে আবার সেই প্রশ্ন—

বল এবার, চিরুনি না ফারুনি?

আমরা কী করব বুঝতে পারছিলাম না। তবে ক্লাসের সবার বুকই যে তখন ড্রামের মতো বাজছিল, এটা বুঝতে পারছিলাম।

এরপরের ঘটনা আমার আর মনে নেই। এ রহস্যময় প্রশ্নের কোনো কূলকিনারা আমরা আর কোনো দিনই করতে পারিনি। তবে শাহ আলম স্যার অনেকটা গল্পের যাদুকরের মতো অনেক ছাত্রের রেজাল্টই রাতারাতি পালটে দিলেন। তিনি ক্লাসের বাইরেও আমাদের পড়াশোনার খবর রাখতেন। যেই আমি ক্লাস ফোর পর্যন্তও টেনেটুনে পাস করতাম, সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই আমিই ক্লাসে ফার্স্ট হয়ে পড়ের ক্লাসে উঠলাম। রেজাল্ট হওয়ার পর স্যার আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন—

‘কি রে ব্যাটা, একেবারে ফার্স্টই হয়ে গেলি?’

আমি কী বলব বুঝে উঠতে না পেরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। দূরের মাইক থেকে ভেসে আসা গানের মতো আমার কানে তখন বেজে চলেছে—চিরুনি না ফারুনি।