আমার অস্তিত্বে মা
মা মানে আমার কাছে অনেক কিছু। স্মৃতিগুলো নেয় পিছু। যখন পর্যন্ত ভাত মেখে খেতে শিখিনি, তখন পর্যন্ত ভাত মেখে খাইয়ে দেওয়া। তারপর আরেকটু বড় হলে মাছের কাঁটা বেছে থালার চারপাশে ফুলের মতো সাজিয়ে রাখা। সপ্তম শ্রেণিতে উঠে নিজ হাতে ভাত মেখে খেতে শিখি। স্কুল থেকে ফিরে দেখতাম, মা ভাত মেখে বসে আছেন। আমি খাওয়া শুরু করতেই মা ঘরের অন্য কাজে চলে যেতে চাইতেন। আমি বলতাম, ‘মা, তুমি পাশে বসে থাকো, না হলে আমি খাব না।’ মা বসে থাকতেন। খাওয়া শেষে হাত ধুয়ে মায়ের আঁচলে হাত আর মুখ মোছা ছিল নিত্যদিনের কাজ।
রাতে যখন মায়ের সঙ্গে ঘুমাতে যেতাম, তখন মনের অজান্তেই মায়ের হাতখানা আমার মাথার চুলে বিলি কাটত। আবার কখনো নিজেই মায়ের হাতখানা টেনে বুকের ওপর রেখে ঘুমিয়ে যেতাম।
মা মানে আমার কাছে অনেক কিছু। তাই তো আজ অনেক স্মৃতি নেয় পিছু। মায়ের চোখ আড়াল করে মধ্যদুপুরে পুকুরে ডুবসাঁতার। বাল্যবন্ধুদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঝাঁপুরি খেলা। চোখ লাল করে ঘরে ফেরা। মায়ের বকুনি আর কানমলা। বাড়ির পাশে বেতের ঝোপে বেতুল কুড়াতে গিয়ে শরীর ছিঁড়ে যাওয়া। মায়ের হাতে গাঁদা অথবা ঝারমণি লতার রস লাগানো। খালের অল্প পানিতে পানি সেঁচে কাদা থেকে শিং, কই, পুঁটি আর ট্যাংরা ধরতে গিয়ে কাঁটা খাওয়া। সন্ধ্যারাতে হারিকেন থেকে মায়ের হাতের সেঁক।
আজ মা হাসলে আমি হাসি। মা আমার কখনো হয় না বাসি। মায়ের চোখের ঝিলিক আমি বড্ড ভালোবাসি। বেশ কয়েক বছর আগে একবার আমার গ্রামের স্কুলের একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বে আমাকে বিশেষ অতিথি করেছিল। প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা শিক্ষা অফিসার। আমি আগের দিন রাতে বাড়ি যাই। সকালে বাজারে শামিম আর আমি আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরছি। মাইকে শুনছি পুরো এলাকায় নাম ঘোষণা করা হচ্ছে। মাকে জিজ্ঞেস করি, ‘মা মাইকে কী কয়?’ মা উত্তর দেন, ‘তোর নাম কয়।’ ‘মাইকে তোমার ছেলের নাম শুনতে কেমন লাগে?’ মা কোনো উত্তর দেন না। আমি তখন মায়ের দিকে তাকিয়ে তাঁর চোখের দ্যুতিতে যে ঝিলিক আর হাসি দেখেছিলাম, তা আমার কাছে অমূল্য। আমি বলে বোঝাতে পারব না, আমার ভেতর সেই ভালো লাগা, কতখানি ভালো লাগা।
মা মানে আমার কাছে এসব অনেক কিছু। বছর চারেক আগে একটি জাতীয় দৈনিকে আমার ছবিসহ যখন প্রথম লেখা ছাপা হয়েছিল, তখন মাকে ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘মা, পেপারে কার ছবি?’ মার দীপ্ত হাসি আমাকে বলেছিল, ‘তোর ছবি।’ আমি আবার মাকে জিজ্ঞেস করি, ‘নিজের ছেলের ছবি দেখতে কেমন লাগে?’ মা মুখে কিছু বলেন না। মা তৃপ্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। সন্তানকে নিয়ে মায়ের চোখে–মুখে এক স্বর্গীয় গৌরব দেখেছিলাম, যা পৃথিবীতে আমার বড় পাওয়া। মা মানে আমার কাছে এই সব। মা যখন আমাকে বুকে জড়িয়ে আদর করে কপালে আশীর্বাদের চুমু এঁকে দেন, তখন সৃষ্টিকর্তা আমার জন্য স্বর্গ নিয়ে আসেন।
মা মানে আমার কাছে স্নিগ্ধ ভালোবাসা। পৃথিবীর সবকিছু একদিকে আর আমার মা অন্যদিকে। মায়ের কাছে সবকিছু ফিকে। দিকে দিকে আমার মা। আমার অস্তিত্বে মা। আমার হৃদয়তন্ত্রীতে মা। সাদা কাঁথার সুচের ফোঁড়ে ফোঁড়ে আমার প্রাণপ্রিয় মা। ‘তুমি সুস্থ থেকো মা। মা, তুমি ভালো থেকো। আর ভালোবেসো আমাকে।’