অনেকেই বলে, তাঁর কীর্তিগুলো সাধারণ ফুটবলাররাও অর্জন করেছে, এমনকি কেউ কেউ তা অতিক্রমও করেছে। তবু ফুটবল মাঠে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের ওপর তাঁর শাসন ছিল অতুলনীয়—যেন এক মায়াবী মোহ, যা প্রত্যক্ষ করা প্রতিটি মানুষকে মুগ্ধ করেছিল বারবার। মাঠে তাঁর শৈলী ছিল বাস্তব আর ভ্রমের মাঝামাঝি কিছু, যা সহজে চোখে ধরা পড়ত না।
কেউ যখন বলে একজন গ্রেট স্ট্রাইকার কেমন হওয়া উচিত, সেই আদর্শে সবার ওপরে সম্ভবত একটি নামই আসে—রোনালদো লুইস নাজারিও দে লিমা; বিশ্বব্যাপী পরিচিত রোনালদো, ও ফেনোমেনো, কিংবা আর৯ নামে। তাই তো আধুনিক ফুটবলের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার করিম বেনজেমাসহ অনেক তারকা ফুটবলারই আদর্শ মানেন ব্রাজিলিয়ান এই কিংবদন্তিকে।
তিনি মাঠে এমন সব ফাঁকা জায়গা দেখতে পেতেন, যা অন্যদের চোখে পড়ত না। বল পায়ে এমন কারুকার্য করতেন, যেন মাঠের ওপরেই আঁকতেন জীবন্ত কোনো চিত্র।
পরিপূর্ণতার আদর্শ উদাহরণ
ফুটবলে রোনালদোর প্রভাব অনেকটা যুক্তিতর্কের ঊর্ধ্বে। মাঠে তিনি খেলতেন ঠান্ডা মাথায়, প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়েরাও ঠিকভাবে বুঝতে পারতেন না কীভাবে তাঁকে আটকাবেন। এ কারণে অনেকের কাছে সর্বকালের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার পর্তুগিজ কিংবদন্তি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর থেকেও এগিয়ে আর৯। একজন স্ট্রাইকারের কাছ থেকে কী কী আশা করা যায় বা কী সম্ভব, তার সংজ্ঞা নতুন করে লিখেছিলেন তিনি। আধুনিক ফুটবলে আজ বিশ্লেষণ ও পরিসংখ্যানের যুগ। এগুলো দিয়েও রোনালদোকে বুঝে ওঠা কঠিন হতো! এর কারণ খুব সহজ; রোনালদো খেলাকে ওই সময় ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন, যখন অনেকেই ঠিক বুঝতে পারেনি তিনি কেন এত বিশেষ।
কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে, রোনালদোকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছিল তাঁর গতি, সঙ্গে ফুটবল নিয়ে নৃত্যশিল্পীর মতো সৌন্দর্য ও নিয়ন্ত্রণের মিশ্রণ। তাঁর খেলায় ছিল এক অসাধারণ স্থিরতা। এটি বোঝা যেত তখন, যখন তিনি প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের ফাঁকি দিয়ে ছুটে যেতেন; ডিফেন্ডারদের পক্ষে তাঁকে থামানো একরকম অসম্ভব ছিল। রোনালদোর ড্রিবলিং যেন এক শিল্পকর্ম।
তিনি মাঠে এমন সব ফাঁকা জায়গা দেখতে পেতেন, যা অন্যদের চোখে পড়ত না। বল পায়ে এমন কারুকার্য করতেন, যেন মাঠের ওপরেই আঁকতেন জীবন্ত কোনো চিত্র। রোনালদোর পছন্দের মুভ ছিল ‘স্টেপ-ওভার’। এটি ইউটিউবের হাইলাইটস ভিডিওতে এখনো দেখতে পাওয়া যায়। স্টেপ-ওভার মুভটি এমন এক কৌশল, যা তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করতে পারতেন।
কৌশলগতভাবে রোনালদো ‘অসমতা’ বা ‘ইমব্যালান্স’-এর ধারণাটাকে ঠিকভাবে আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন। ফুটবল হলো ভারসাম্য ও অবস্থান নির্ধারণের খেলা। রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় কীভাবে গঠন ধরে রাখতে হয়, স্ট্রাইকারদের পথ বন্ধ করতে হয়, এবং শরীর এমনভাবে ভারসাম্য করতে হবে, যাতে প্রতিপক্ষ সহজে গোলের দিকে যেতে না পারে। রোনালদো এই পুরো কাঠামোকেই পাল্টে দিয়েছিলেন।
বল নিয়ে এগোনোর সময় রোনালদোর ভেলকি, শরীরের প্রতিটি বাঁক প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের বোকা বানাত। তাঁরা ভুল দিকে সরতে বাধ্য হতো। ঠিক ওই মুহূর্তে চোখের পলকেই ডিফেন্ডারদের পাশ কাটিয়ে গোলপোস্ট বরাবর ছুটে যেতেন তিনি। কৌশলগত দিক থেকে এটাই ছিল রোনালদোর সত্যিকারের জাদু। তিনি মাঠে কখনো স্থির থাকতেন না। কখনোই এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকতেন না, যাতে প্রতিপক্ষ তাঁর পরবর্তী কৌশল বুঝে ফেলতে পারে। গোলপোস্টের দিকে পিঠ দিয়ে বল নিতে পারতেন, হালকা এক ছোঁয়ায় প্রতিপক্ষকে পেছনে ফেলে ঘুরে দাঁড়াতেন, তারপর চিতার মতো দৌড়ে ঢুকে যেতেন ফাঁকা জায়গায়। মুহূর্তেই বদলে দিতে পারতেন পুরো ম্যাচের গতিপথ।
রোনালদোর গতি ছিল ভয়ানক, আর ছন্দ বদলের কৌশল প্রতিপক্ষকে করে দিত বিভ্রান্ত। তিনি জানতেন কখন দৌড়াতে হবে, কখন অপেক্ষা করতে হবে, কখন প্রতিপক্ষকে নিজের দিকে টেনে আনতে হবে, আর কখন প্রতিপক্ষের ফাঁকা জায়গায় ঝড়ের মতো ঢুকে পড়তে হবে।
অপরাজেয় মানসিক শক্তি
রোনালদো রহস্য পুরোপুরি বুঝতে হলে দুই–দুইবার হাঁটুর ভয়ংকর চোট থেকে ফিরে আসার অদম্য মানসিকতার কথাও বলতে হবে। ১৯৯৯ সালে, গোটা বিশ্ব আঁতকে উঠেছিল রোনালদোকে মাঠে পড়ে যেতে দেখে। তাঁর হাঁটু পুরোপুরি ভেঙে গিয়েছিল। লিগামেন্ট ছিঁড়ে যাওয়ার সেই শব্দ এখনো দর্শকদের কানে বেজে ওঠে। অনেকে ভেবেছিল ক্যারিয়ার হয়তো এখানেই শেষ। কিন্তু মানুষটা যে রোনালদো, হার মানেননি। অদম্য মানসিক শক্তি, হারিয়ে যাওয়া সিংহাসন পুনরুদ্ধারের জেদ—এসবই তাঁকে আবার তুলে আনে ফুটবলের রাজত্বে।
চোট থেকে সুস্থ হয়ে মাঠে ফিরে এসেছিলেন এক অদম্য প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে। ২০০২ সালে ব্রাজিলকে জেতালেন পঞ্চমবারের মতো বিশ্বকাপ শিরোপা। ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে দুই গোলসহ পুরো টুর্নামেন্টে করলেন সর্বাধিক ৮ গোল। জেতেন ফিফা বেস্ট ফুটবলার ও দ্বিতীয়বারের মতো ব্যালন ডি’অর পুরস্কার। তিনি প্রমাণ করলেন, প্রতিভা ও অপরাজেয় মানসিক শক্তির সম্মিলনে কীভাবে অসাধ্যকে সাধন করা যায়।
ব্রাজিলের মুকুটমণি
ব্রাজিলের কাছে রোনালদো কেবল একজন ফুটবলারই ছিলেন না, হয়ে উঠেছিলেন জাতীয় পরিচয়ের অংশ। ফুটবল যদি আনন্দ আর অভিব্যক্তির খেলা হয়, তার জীবন্ত প্রতীক তিনি। সেলেসাওর জার্সিতে অতিমানবীয় পারফরম্যান্স তাঁকে ফুটবল ইতিহাসের সেরাদের সেরা তালিকায় স্থান করে দিয়েছে।
রোনালদোকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছিল বিশ্বমঞ্চে তাঁর পারফর্ম করার দক্ষতা। বিশ্বকাপকে বলা হয় কিংবদন্তিদের জন্ম নেওয়ার মঞ্চ। সেখানে ১৯৯৮ ও ২০০২ সালের বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স তাঁকে সর্বকালের সেরা স্ট্রাইকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। এর আগে ১৯৯৪ সালেও ব্রাজিলের হয়ে বিশ্বকাপ জেতেন। কেউ কেউ বলেন ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপে রোনালদো ইনজুরিতে না পড়লে সেদিন ফাইনালে ফ্রান্স নয়, বরং ব্রাজিলের ঘরেই যেত সোনালি ট্রফিটি। তিনি শুধু নিজের জন্য খেলতেন না; কাঁধে ছিল একটি জাতির স্বপ্ন, এবং তিনি সেই স্বপ্ন পূরণে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন।
রোনালদো শিখিয়েছেন শুধু প্রতিভা যথেষ্ট নয়, এর সঙ্গে থাকতে হয় অদম্য মানসিকতা। ফুটবল খেলতে হয় মনের আনন্দে, উল্লাসে ও সৃজনশীলতার মিশ্রণে। তাঁর ড্রিবল, গোল, আর উদ্যাপনে সেই আনন্দ প্রকাশ পেত। একজন সাধারণ ফুটবল সমর্থকের মনে রোনালদো আজও অমলিন।
ব্রেকিংদ্যলাইনস ডটকম থেকে অনূদিত