হারের ভেতর দিয়ে গড়া এক রাজ্যের রাজার গল্প

আইপিএল জয়ের পর বিরাট কোহলির বাঁধনহারা উচ্ছ্বাসছবি: বিসিসিআই
বিরাট কোহলিরা শত হোঁচট খেয়েও থামেন না। এ জন্যই বোধ হয় তিনি বিশ্বসেরা হতে পেরেছেন। তাঁর ভক্তরা তাঁকে ডাকে কিং কোহলি।

ওয়ানডে বিশ্বকাপ থেকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি থেকে এশিয়া কাপ—আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের প্রতিটি শিরোপাই তাঁর হাতের ছোঁয়া পেয়েছে। ক্রিকেটে জেতা যায়, এমন সবকিছুই তিনি জিতেছেন। তবু একটা ট্রফির জন্য ছিল হাহাকার। বছরের পর বছর হৃদয়ে রয়ে গিয়েছিল একধরনের না পাওয়ার বেদনা। সমালোচকেরা বলতেন, এত বড় খেলোয়াড়, তবু একবারও আইপিএল শিরোপা জিততে পারলেন না?

প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের বিখ্যাত সেনাপতি জুলিয়াস সিজারের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে—‘ভিনি, ভিডি, ভিসি।’ যার বাংলা এলাম, দেখলাম, জয় করলাম। ক্রিকেটে বিরাট কোহলি যেন ব্যাট হাতে সবকিছুই এভাবে জয় করলেন। কিন্তু আইপিএল শিরোপার ক্ষেত্রে এই বাণীটি কোনোভাবেই প্রযোজ্য হচ্ছিল না। তিনি ব্যাট হাতে রানের পাহাড় গড়েছেন। একের পর এক রেকর্ড ভেঙেছেন। রেকর্ড গড়েছেন। কিন্তু আইপিএলের শিরোপা জয়ের পথে তাঁকে পেছাতে হয়েছে বারবার। তবু ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য একবারও রয়েল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু ছেড়ে যাননি। গেল ১৭ বছর নিজের সবটা উজাড় করে দিয়েছিলেন। দলগত সাফল্যের শেষ পর্যায়ে গিয়েও হোঁচট খেয়েছেন বারবার।

৩ জুন ২০২৫—সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে আরও একটি আইপিএলের ফাইনাল খেলতে নামলেন বিরাট কোহলি। গ্যালারিতে প্রায় এক লাখ দর্শকের উন্মাদনা। মুখোমুখি রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু ও পাঞ্জাব কিংস। লাল-কালো জার্সিতে মাঠে দাঁড়িয়ে বিরাট কোহলি হয়তো ভাবছিলেন ১৮ বছরের অপেক্ষা, শত গ্লানি আর অগণিত সমালোচনা থেকে এবার মুক্তি মিলবে তো!

১৮ বছর আগের কথা। সাল ২০০৮। কোহলি তখন ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়ক। রাজধানী দিল্লিতে তাঁর জন্ম, দিল্লির হাওয়া–বাতাসেই বেড়ে ওঠা। ইতিমধ্যে ভারতের রঞ্জি ট্রফি এবং সাদা বলের ক্রিকেটে রাজ্যদলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। কোহলির নেতৃত্বে টিম ইন্ডিয়া অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জেতার ঠিক পরপরই অনুষ্ঠিত হয় আইপিএলের নিলাম। ৩০ লাখ রুপিতে দিল্লির চিকুকে দলে নেয় রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু। আইপিএলের উদ্বোধনী ম্যাচেই খেলেছিলেন বিরাট কোহলি। সেই ম্যাচটিতে মাত্র ১ রান করেই সাজঘরে ফিরেছিলেন।

আইপিএল ট্রফি পাশে রেখে শিশুর মতো উদ্‌যাপন করেন কোহলি
এএফপি

কে জানত কিংবা কেউ কি সেদিন কল্পনা করেছিল, এই ছেলে একদিন হবে আইপিএলের ইতিহাসের সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক! আইপিএলের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রানের মালিক (৮৬৬১)। সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরিও (৮টি) তাঁর দখলে। সবচেয়ে বেশি হাফ সেঞ্চুরির (৬৩টি) রেকর্ডও আগে থেকেই ছিল দখলে। আইপিএলের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি চার মারা ক্রিকেটারের নামও বিরাট কোহলি।

এবারের আগে বিরাট কোহলি আইপিএলের ফাইনাল খেলেছেন ২০০৯, ২০১১ ও ২০১৬ সালে। এর মধ্যে ২০১৬ সালে হায়দরাবাদের বিপক্ষে ফাইনালে করেছিলেন ৫৪ রান, কিন্তু দল জেতেনি। সেই মৌসুমেই করেছিলেন ৯৭৩ রান, যা এখনো এক মৌসুমে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। ২০১১ সালে ফাইনালে চেন্নাইয়ের কাছে হেরেছিল আরসিবি। ২০২৩ সালে গুজরাট টাইটান্সের বিপক্ষে কোয়ালিফায়ারে দুর্দান্ত খেলেও ফাইনালে পৌঁছাতে পারেননি। ফাইনালের দরজায় গিয়ে বারবার হতাশ হয়েছেন কোহলি। তবে ২০২৫ সালে এসে সব হিসাব পাল্টে দিলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা কিংবা তর্ক সাপেক্ষে সর্বকালের সেরা এই ব্যাটার।

২০২৫ সালের ফাইনালের শেষ মুহূর্তে জয় নিশ্চিত হওয়ার পর চোখে জল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন বিরাট কোহলি। সেই জল যেন ছিল আনন্দের, পরিতৃপ্তির। ম্যাচ শেষে ডি ভিলিয়ার্স ও ক্রিস গেইলকে জড়িয়ে ধরেছিলেন তিনি, যাঁরা স্টেডিয়ামে উপস্থিত ছিলেন তাঁদের একসময়ের সতীর্থের এই মাহেন্দ্রক্ষণ দেখতে। পুরো গ্যালারি কোহলি, কোহলি ধ্বনির উন্মাদনায় মেতে ওঠেছিল। হয়তো পাঞ্জাব কিংসের কোনো পাড় ভক্তও নিজের দলের শিরোপা না জিততে পারার দুঃখ ভুলে কোহলির হাতে আইপিএলের ট্রফি দেখে আনন্দ খুঁজে নিয়েছিলেন।

রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু দলটারও ফুরিয়েছে ১৮ বছরের অপেক্ষা। ‘চিকু ভাই’-এর জন্য তারা যেন খেলেছে সবটুকু নিংড়ে। স্বাভাবিকভাবেই ডাগআউটে তখন আরসিবি টিমের বাকি খেলোয়াড়েরা আনন্দে–উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছিলেন। অধিনায়ক হিসেবে চলতি মৌসুমে পাশে থাকা রাজাত পাতিদারসহ সবাই এক কণ্ঠে বলছিলেন, এই ট্রফিটা বিরাট ভাইয়ের প্রাপ্য ছিল।

এক প্রবীণ ভক্ত একটি সংবাদমাধ্যমে বলছিলেন, ‘আমার ছেলেরা ধোনির ফ্যান, আমি কোহলির। এই ট্রফির জন্য কত রাত জেগেছি, কত হার দেখে কেঁদেছি!’

ট্রফি হাতে বিরাট কোহলি
ইনস্টাগ্রাম

রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর জন্য এই শিরোপা জয় শুধু একটি ট্রফি ছিল না। ছিল কোটি ভক্তের অপেক্ষার অবসানও। বিরাট কোহলি প্রমাণ করে দেখালেন, ক্রিকেটে কখনো কখনো পরিসংখ্যানের চেয়েও অনেক বড় হয়ে উঠতে পারে একটি ট্রফি।

আহমেদাবাদে বিরাট কোহলি যেন মনে করিয়ে দিলেন স্কটল্যান্ডের রবার্ট দ্য ব্রুসের কথা। গুহায় বসে তিনি দেখেছিলেন এক মাকড়সার সাতবার পড়ে আবার অষ্টমবার জাল বুনে সফল হওয়া, তেমনি বিরাট কোহলিও আইপিএলে ছিলেন বারবার হোঁচট খাওয়া এক যোদ্ধা। যিনি বারবার হেরেছেন। অনেক কাছে গিয়েও হেরেছেন। কিন্তু একবারও হাল ছাড়েননি। হয়তো তিনি জানতেন লাল-কালো জার্সিতে ট্রফি একদিন উঁচিয়ে ধরতে পারবেন।

মাকড়সার মতো আটবারে হয়নি, বিরাট কোহলি আইপিএলের শিরোপা জিতেছেন ১৮ বার চেষ্টার পর। অবশেষে তিনি সফল হলেন। পেছনে ছিল তাঁর একাগ্র চেষ্টা এবং নিজের প্রতি অনড় বিশ্বাস। কখনো কখনো ইতিহাস শুধু বিজয়ীদের মনে রাখে না। মনে রাখে সেই মানুষটিকে, যে হারের মধ্যেও বিশ্বাস রাখে একদিন ঠিকই জয়ের দেখা পাব। বিরাট কোহলি কিংবা দিল্লির সেই চিকু এমন একটি নাম। যিনি প্রমাণ করে দিলেন, কিছু জিনিসের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। জীবন অপেক্ষা করিয়ে রাখে, কিন্তু হাল ছাড়া যাবে না। হোঁচট মানেই থেমে যাওয়া নয়। সেখানে থেমে গেলে আপনার গল্পটাও থেমে যাবে।

বিরাট কোহলিরা শত হোঁচট খেয়েও থামেন না। এ জন্যই বোধ হয় তিনি বিশ্বসেরা হতে পেরেছেন। তাঁর ভক্তরা তাঁকে ডাকে কিং কোহলি। বিরাট কোহলি যদি ক্রিকেটের রাজা হন। তিনি এমন এক রাজা ছিলেন, যিনি ক্রিকেটের সবকিছু জয় করেছেন; কিন্তু নিজের রাজ্যটাই এত দিন জয় করতে পারেননি। অবশেষে ক্রিকেটের রাজা পেলেন ঘরের মুকুট। জয় করলেন নিজ রাজ্য।

সাবেক সভাপতি, নোয়াখালী বন্ধুসভা