ক্রিকেটে খেলোয়াড়দের র‍্যাঙ্কিং কীভাবে নির্ধারণ করা হয়

আইসিসি র‍্যাঙ্কিং।

যখনই আইসিসি (আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল) খেলোয়াড়দের র‍্যাঙ্কিং প্রকাশ করে, দেখা যায় তালিকায় শীর্ষস্থানগুলো বা সেরা দশের মধ্যে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটারদের প্রাধান্য বেশি। এমনকি এ দেশগুলোর হয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন মাত্র দেড় থেকে দুই বছর হলো—এমন ক্রিকেটাররাও সেরা তিনের মধ্যে চলে আসেন। অন্যদিকে বাংলাদেশি খেলোয়াড়েরা ভালো খেলেও ব্যাটিং-বোলিং র‍্যাঙ্কিংয়ে সেরাদের মধ্যে আসতে পারেন না! এর কারণ কী?

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভক্তরা অভিযোগ করেন, বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের আইসিসি অবমূল্যায়ন করে! আসলেই কি তাই? ভক্তদের সংশয় দূর করতে এ লেখায় আইসিসির খেলোয়াড় র‍্যাঙ্কিং কীভাবে গণনা করা হয়, তা নিয়ে আলোচনা ও বিশ্লেষণ করব।

আইসিসির র‍্যাঙ্কিং সিস্টেম
সাম্প্রতিক সময়ের সেরা খেলোয়াড় বাছাই করার জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারদের নিয়ে আইসিসি একটি র‍্যাঙ্কিং প্রকাশ করে থাকে। খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স হিসাব করা হয় ০ থেকে ১০০০ রেটিং পয়েন্টের মধ্যে। যদি কোনো ক্রিকেটারের পারফরম্যান্স পূর্ববর্তী বছরের বা পূর্ববর্তী সিরিজের তুলনায় বাড়ে, তাহলে তাঁর রেটিং পয়েন্ট বৃদ্ধি পায়। আর যদি পারফরম্যান্স পূর্ববর্তী বছরের বা পূর্ববর্তী সিরিজের তুলনায় খারাপ হয়, তাহলে রেটিং পয়েন্ট কমে যায়। নতুন খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে রেটিং পয়েন্ট ০ থেকে হিসাব করা হয়। পয়েন্ট বাড়ানোর জন্য তাঁকে প্রতিটি ম্যাচে ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলতে হবে। এক ম্যাচ ভালো খেলে পরেরগুলো খারাপ খেললে রেটিং কমে যাবে।

রেটিং পয়েন্ট হালনাগাদ করার এ কাজে কোনো মানুষের ছোঁয়া থাকে না। পুরো প্রক্রিয়াটি আইসিসির একটি নিজস্ব কম্পিউটারাইজড অ্যালগরিদম স্বয়ংক্রিয়ভাবে করে থাকে। এ ক্ষেত্রে রান, উইকেট–সংখ্যা, ম্যাচের প্রেক্ষাপট, প্রতিপক্ষ দল, প্রতিপক্ষ বোলার/ব্যাটসম্যানের শক্তি, কন্ডিশনসহ বিভিন্ন ফ্যাক্টর বিবেচনায় নেওয়া হয়।

সাধারণ নিয়মাবলি
সর্বোচ্চ রেটিং: ১০০০ পয়েন্ট। ৫০০ পয়েন্ট হলে একজন খেলোয়াড়কে ভালো বলে বিবেচনা করা হয়। ৭৫০ পয়েন্ট হলে সাধারণত সেরা দশের মধ্যে স্থান করে নেন। ৯০০ পয়েন্ট যাঁদের হয়, তাঁদের বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
প্রতিটি ম্যাচের পর পয়েন্ট বাড়তে বা কমতে পারে। এটা নির্ভর করে খেলোয়াড়ের পারফরম্যান্স, প্রতিপক্ষ দলের শক্তি, ম্যাচের গুরুত্ব (যেমন বিশ্বকাপ বনাম সাধারণ সিরিজ)।
নতুন খেলোয়াড়দের একটি নির্দিষ্টসংখ্যক ম্যাচ খেলার পর র‍্যাঙ্কিংয়ে স্থান দেওয়া হয়।
র‍্যাঙ্কিংয়ে স্থান পেতে হলে অবশ্যই একজন খেলোয়াড়কে টেস্টে সর্বশেষ ১২ থেকে ১৫ মাস ধারাবাহিকভাবে খেলতে হবে এবং ওডিআই ও টি-টোয়েন্টিতে ৯ থেকে ১২ মাস।
টেস্টে সাধারণত প্রতিটি ম্যাচ শেষেই র‍্যাঙ্কিং হালনাগাদ করা হয়। ওডিআই ও টি-টোয়েন্টির ক্ষেত্রে প্রতিটি সিরিজ শেষে র‍্যাঙ্কিং হালনাগাদ করা হয়।
সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স বেশি গুরুত্ব পায়।

ব্যাটিং র‍্যাঙ্কিং
যে বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়—
• ব্যক্তিগত রান: নির্দিষ্ট একটি ম্যাচে একজন ব্যাটসম্যান কত রান করেছেন, তা রেটিং পয়েন্টের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে ম্যাচ বাই ম্যাচ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে। ধরুন, কোনো একটা সিরিজ বা টুর্নামেন্টে পাঁচটি ম্যাচ। পাঁচটি ম্যাচেই একজন ব্যাটসম্যান ভালো রান করেছেন, তাহলে তাঁর রেটিং পয়েন্ট বৃদ্ধি পাবে। আর যদি প্রথম ম্যাচে সেঞ্চুরি করার পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় ম্যাচে রানের সংখ্যা ৫০-এর নিচে থাকে, তাহলে রেটিং পয়েন্ট কমে যাবে। অর্থাৎ রেটিং বাড়াতে হলে পূর্ববর্তী ম্যাচের তুলনায় আপনাকে ভালো খেলতেই হবে।
• ম্যাচের প্রেক্ষাপট (চাপের মুহূর্ত, ম্যাচ জয়-পরাজয় ইত্যাদি): ধরুন, বাংলাদেশের ম্যাচ জিততে দরকার ৩০০ রান। দলের স্কোর ৬৫ রানে ৩ উইকেট। এ অবস্থায় একজন ব্যাটসম্যান দাঁড়িয়ে গেলেন এবং ম্যাচ জেতালেন। তখন ওই ব্যাটসম্যানের রেটিং পয়েন্ট অনেক বেশি বাড়বে। অর্থাৎ আপনার ইনিংসটি দলের জয়ে কতটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে, তা মূল্যবান।
• আউট-নট আউট: যদি ব্যাটসম্যানটি সেঞ্চুরি করে অপরাজিত থেকে দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়েন, তখন তাঁর রেটিং পয়েন্ট বেশি হবে। আর যদি ব্যাটসম্যানের কারণে দল জয় পায়, কিন্তু তিনি নিজের সেঞ্চুরির পর আউট হয়ে গেলেন; তখনো রেটিং পয়েন্ট বাড়বে। তবে অপরাজিত থাকলে যা পেতেন, সেটা থেকে কিছুটা কম পাবেন।

• প্রতিপক্ষ বোলারদের শক্তি: ধরুন, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের ম্যাচ। অস্ট্রেলিয়া দলে আছেন প্যাট কামিন্স, মিচেল স্ট্রাকদের মতো বিশ্বসেরা বোলাররা। তাঁদের বিপক্ষে ভালো ব্যাটিং করে ম্যাচে জয় ছিনিয়ে আনেন নাজমুল শান্ত-তৌহিদ হৃদয়রা। তখন নাজমুল শান্ত-তৌহিদ হৃদয়দের রেটিং বেশি বৃদ্ধি পাবে। আর যদি প্রতিপক্ষ বোলাররা হন জিম্বাবুয়ে বা নেপালের এবং জয় একইভাবে হয়; তখন রেটিং পয়েন্ট খুব একটা বাড়বে না।
• হোম না অ্যাওয়ে ম্যাচ: ঘরের মাঠে ভালো রান করলে রেটিং পয়েন্ট যা বাড়বে, বিদেশের মাটিতে ভালো করলে পয়েন্ট আরও বেশি বাড়বে।
• ম্যাচের স্কোরের ধরন (কম স্কোরিং নাকি বেশি স্কোরিং ম্যাচ): যেমন ধরুন, ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ। সম্পূর্ণ বোলিং পিচ। কোনো ব্যাটসম্যানই বেশিক্ষণ ক্রিজে টিকে থাকতে পারছে না। দলের রান হলো ৫০ ওভারে সব কটি উইকেট হারিয়ে ২২০। এর মধ্যে তৌহিদ হৃদয়ের রান ১১০, বাকি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে কেউ ১০, কেউ ১৫, কেউ ৮ রান করেন। এ ক্ষেত্রে তৌহিদ হৃদয়ের রেটিং পয়েন্ট বৃদ্ধি পাবে। আর যদি ভালো পিচে দলের রান ৫০ ওভারে ৩৫০ হয়; যেখানে তৌহিদ হৃদয়ের রান ১৩০+, তখনো তাঁর রেটিং বাড়বে। তবে কম স্কোরিং পিচে ভালো ব্যাটিং করে যে রেটিং পেয়েছিলেন, সে তুলনায় কিছুটা কম বাড়বে।

বোলিং র‍্যাঙ্কিং
যে বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়—
• ব্যক্তিগত উইকেট: নির্দিষ্ট একটি ম্যাচে একজন বোলার কত উইকেট নিয়েছেন, তা রেটিং পয়েন্টের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে ম্যাচ বাই ম্যাচ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে। ধরুন, কোনো একটা সিরিজ বা টুর্নামেন্টে পাঁচটি ম্যাচ। পাঁচটি ম্যাচেই একজন বোলারকে ধারাবাহিকভাবে উইকেট নিতে হবে। শক্তিশালী দলের বিপক্ষে ৫ উইকেট পাওয়া গেলে বেশি পয়েন্ট মেলে।
• কত রান দিয়েছেন: উইকেট নেওয়ার তুলনায় যদি রান বেশি খরচ করেন, তাহলে রেটিং কম বৃদ্ধি পাবে। আর যদি রান কম খরচ করেন, তাহলে রেটিং বেশি বৃদ্ধি পাবে। টি-টোয়েন্টি ও ওডিআইয়ে মিতব্যয়ী বোলিং (ইকোনমি রেট কম) গুরুত্বপূর্ণ।
• প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের শক্তি: যদি র‍্যাঙ্কিংয়ের সেরা ব্যাটসম্যানদের আউট করতে পারেন, তাহলে রেটিং বেশি বৃদ্ধি পাবে। আর সাধারণ মানের ব্যাটসম্যানদের আউট করলে পয়েন্ট কম বাড়বে।

• ম্যাচের প্রেক্ষাপট: কোনো একটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে প্রতিপক্ষ দলের জিততে দরকার ২ ওভারে ১০ রান। এ অবস্থায় একজন বোলার যদি প্রতিপক্ষকে আটকে দিতে পারেন, তাহলে রেটিং পয়েন্ট বেশি হবে। অন্যদিকে যদি প্রতিপক্ষ দলের জিততে দরকার হয় ৫ ওভারে ১০০ রান, তখন একজন বোলার ভালো বল করলেন; তাহলে রেটিং পয়েন্ট কম বাড়বে।
• পিচ ও ম্যাচের পরিবেশ: ম্যাচের স্কোরের ধরন অনুযায়ী এটা হিসাব করা হয়। যেমন কম স্কোরিং ম্যাচে ভালো বল করলে যে পয়েন্ট পাওয়া যাবে, বেশি স্কোরিং ম্যাচে একই মানের ভালো বল করলে আরও বেশি রেটিং পয়েন্ট পাওয়া যাবে।

অলরাউন্ডার র‍্যাঙ্কিং
যে বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়—
এই র‍্যাঙ্কিং নির্ধারিত হয় ব্যাটিং ও বোলিং রেটিং একসঙ্গে বিবেচনা করে।
শুধু যাঁরা ব্যাটিং ও বোলিং উভয় ক্ষেত্রে যোগ্য, তাঁদেরই অলরাউন্ডার হিসেবে র‍্যাঙ্কিং দেওয়া হয়।

সূত্র: আইসিসি