এক আগুনপাখির গল্প

ভারতের নারী ক্রিকেট দলে রিচা ঘোষের উত্থান রূপকথাকেও হার মানায়বিসিসিআই

এই মেয়েটি বাঙালি।
চিনতে পারছেন?
বাঙালি হলেও এখনো অনেকেই তাকে চিনি না আমরা।
আসুন, আমরা সেই মেয়েটিকে একটু চিনি...একটু জানি।
হয়তো এই জানা দিয়ে আমরা আমাদের মেয়েকে তৈরি করতে পারব...
আমরা যখন বাঙালি ও ক্রিকেট—এই দুটো শব্দকে এক ফ্রেমে বাঁধি,
তখন আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে লর্ডসের ব্যালকনিতে
এক মহারাজের জার্সি ওড়ানোর দৃশ্য।
আমাদের মনে পড়ে চাকদহ এক্সপ্রেসের সেই অদম্য দৌড়,
যা বিশ্ব ক্রিকেটকে শাসন করেছে।
কিন্তু আজ, এই বিশ্বজয়ের সন্ধ্যায়,
আমি আপনাকে এমন এক বাঙালির গল্প শোনাব,
যার উত্থান রূপকথাকেও হার মানায়।

‘এক আগুনপাখির গল্প’
এই গল্পটা ঠিক কোথা থেকে শুরু করা উচিত?
শুরুটা কি সেই চার বছরের মেয়েটা থেকে,
যে শিলিগুড়ির বাড়ির উঠোনে প্লাস্টিকের ব্যাট ঘোরাচ্ছে?
নাকি সেই একরোখা বাবা, মানবেন্দ্র ঘোষের থেকে,
যিনি ক্রিকেটারের চোখে এক জহুরির মতো নিজের সন্তানকে চিনে ফেলেছিলেন?
নাহ্, এই গল্পের শুরুটা আরও গভীর।
এর শুরুটা কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে তাকিয়ে থাকা একটা শহর থেকে।
শিলিগুড়ি।
পাহাড়ের পায়ের কাছে, চা–বাগানের সবুজ গালিচার পাশে যার বাস।
শহরটা শান্ত, স্নিগ্ধ, বড়ই ঘরোয়া।
এই শান্ত, কুয়াশামোড়া শহর থেকে কি কোনো ঝড়ের জন্ম হতে পারে?
এমন কালবৈশাখী, যা গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেবে?
পারে।
সেই ঝড়েরই নাম, রিচা ঘোষ।
এই গল্পটা শুধু রিচার নয়।
এই গল্পটা একটা মেয়ের আড়ালে থাকা এক বাবার।
মানবেন্দ্র ঘোষ।
শিলিগুড়ির এক পার্টটাইম আম্পায়ার
এবং স্থানীয় ক্লাবের একনিষ্ঠ সেবক।

মানবেন্দ্রবাবুর নিজের একটা স্বপ্ন ছিল।
তিনি নিজে ক্রিকেটার হতে পারেননি।
সেই অতৃপ্ত স্বপ্নটা, সেই না-পাওয়াটা,
তিনি চার বছরের ছোট্ট মেয়েটার চোখে রোপণ করে দিয়েছিলেন।
যখন রিচা প্রথম ব্যাট হাতে নিল,
তখন সেই বাবা শুধু একটুকরো কাঠ দেননি,
তিনি মেয়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন নিজের অপূর্ণ জীবনের এক পবিত্র দায়িত্ব।
কিন্তু এ যে শিলিগুড়ি!
এ শহর কলকাতা নয়।
এখানে মেয়েদের ক্রিকেট খেলার রেওয়াজ নেই,
পরিকাঠামো তো দূরের কথা।
মানবেন্দ্রবাবু যখন মেয়েকে নিয়ে মাঠে যেতেন,
তখন চারপাশ থেকে হয়তো ভেসে আসত সেই পরিচিত হাসির শব্দ,
সেই কটু মন্তব্য,
‘আরে, মেয়ে হয়ে ছেলেদের সঙ্গে খেলছে!’
‘এসব করে কী হবে?’
এই সব প্রশ্ন যার কানে ঢোকেনি, সে হলো রিচা।
আর যিনি এই প্রশ্নগুলোকে মেয়ের কান পর্যন্ত পৌঁছাতে দেননি, তিনি হলেন মানবেন্দ্র ঘোষ।

গল্প নয়, এটা এক কঠিন সত্যি।
রিচার যখন প্রথম একটা ভালো ব্যাটের দরকার হলো,
একটা ইংলিশ উইলো ব্যাট,
তখন তার দাম শুনে থমকে গিয়েছিলেন বাবা।
একজন সামান্য আম্পায়ার, ব্যবসা চলে সামান্য।
যিনি ছোটখাটো ব্যবসা করে সংসার চালান,
তাঁর কাছে অত টাকা কোথায়?
কিন্তু তিনি যে জহুরি!
তিনি জানতেন, তাঁর ঘরে যে হীরা আছে,
তাকে ঘষামাজা করার জন্য এইটুকু দরকার।
রিপোর্ট অনুযায়ী, মানবেন্দ্রবাবু তাঁর ছোট্ট ব্যবসার প্লটটি বিক্রি করে দিয়েছিলেন।
ভাবতে পারেন?
একটা গোটা পরিবারের রুটি-রুজি, ভবিষ্যতের ভরসা,
সবটা তিনি বাজি ধরেছিলেন মেয়ের স্বপ্নের ওপর।
আজ,
এই বাবা এক রূপকথার জন্মদাতা।
আর রিচা?
সেই মেয়েটা কী করছিল?
সে তখন শিলিগুড়ির মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
বাঘা যতীন অ্যাথলেটিক ক্লাবে সে-ই ছিল একমাত্র মেয়ে।
মেয়েদের কোনো টুর্নামেন্ট নেই,
তাই সে নির্দ্বিধায় খেলে যাচ্ছে ছেলেদের সঙ্গে, ছেলেদের দলেই।
সে কারণেই বোধ হয় রিচার ব্যাটিংয়ে কোনো ‘মেয়েলি’ নমনীয়তা নেই,
আছে এক অদম্য, কাঁচা বারুদের জোর।
তাকে যে ছেলেদের বল খেলতে হতো,
ছেলেদের চেয়ে জোরে বল করতে হতো,
তাই তার ব্যাটে আজ এত তেজ।

রিচা ঘোষ
আইসিসি

তার আইডল? মহেন্দ্র সিং ধোনি।
তাই প্রথম থেকেই তার লক্ষ্য ছিল বলকে সীমানার বাইরে পাঠানো।
এই যে মেয়েটা, যাকে দেখে আজ সবাই মুগ্ধ,
তার শৈশবটা কেমন ছিল জানেন?
যখন তার বন্ধুরা পুতুল খেলায় মত্ত,
তখন রিচা শিলিগুড়ির মাঠে ছেলেদের বলকে বাউন্ডারির বাইরে পাঠাচ্ছে।
সেই বল কুড়াতে গিয়ে কতবার যে কটু কথা শুনতে হয়েছে,
তার ইয়ত্তা নেই।
বাবা ছিলেন পার্টটাইম আম্পায়ার,
মেয়েকে নিয়ে বাইকে করে যেতেন এক মাঠ থেকে আরেক মাঠে।
সেই ছোট্ট মেয়েটা, বাবার আঙুল ধরে,
পিঠে ভারী কিটব্যাগ নিয়ে,
রোদে জ্বলে–পুড়ে এক অদম্য জেদকে লালন করছিল।
রিচার ব্যাটটা কোনো কবির তুলি নয়।
রিচা ঘোষ নামের এই মেয়েটি বাইশ গজে ললিতকলা আঁকতে আসেনি।
সে এসেছে আগুন ঝরাতে।
তার ব্যাটিংয়ে শাস্ত্রীয় সংগীতের ঘরানা নেই,
আছে বাঁধভাঙা নদীর উদ্যমতা।
তার ব্যাটটা কোনো তলোয়ার নয়,
ওটা একটা গদা।
যখন সে ক্রিজে আসে,
তখন বোলারদের চোখে ভয় ঘনায়।
কারণ তারা জানে,
এই মেয়েটি ‘অপেক্ষা’ করতে শেখেনি,
সে শিখেছে শুধু ‘আঘাত’ করতে।
প্রতিভা চাপা থাকে না।
শিলিগুড়ির সেই ঝড় এসে পৌঁছাল কলকাতায়।
ডাক এল বাংলার ক্রিকেট ক্যাম্পে।
তারপর যা ঘটল,
তা কোনো স্বাভাবিক উত্থান নয়,
তা এক উল্কা-পতন!

মাত্র এগারো বছর বয়সে রিচা বাংলার অনূর্ধ্ব-১৯ দলে সুযোগ পেল।
বারো বছর বয়সে ডাক পেল অনূর্ধ্ব-২৩ দলে।
মাত্র তেরো বছর বয়সে বাংলার সিনিয়র দলে তার অভিষেক হলো!
ভাবুন একবার,
যে বয়সে মেয়েরা স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর কথা ভাবে,
সেই বয়সে রিচা বাংলার সিনিয়র দলের ড্রেসিংরুমে।
এটা কোনো গল্প নয়,
এটাই রিচা ঘোষের বাস্তব।
বাংলার হয়ে তার বিধ্বংসী ইনিংসগুলো নির্বাচকদের বাধ্য করল তার কথা ভাবতে।
ফল?
মাত্র ১৬ বছর বয়স।
রিচা ঘোষ ডাক পেল ভারতের সিনিয়র দলে।
সোজা ২০২০ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মঞ্চে!
যে মেয়েটা কদিন আগেও শিলিগুড়ির মাঠে ছেলেদের সঙ্গে অনুশীলন করছিল,
সে আজ অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে বিশ্বমঞ্চে ভারতের জার্সি গায়ে।
তারপরের যাত্রাটা আমাদের চোখের সামনেই।
অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয়
ডব্লিউপিএলে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর হয়ে ১.৯ কোটির সেই ঐতিহাসিক চুক্তি, বিদেশে আরেক সাইনিং।
আর সবশেষে...
ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়।

২০২৫-এর বিশ্বকাপ ফাইনাল।
২৯৮ রানের পুঁজি।
রিচা ঘোষের অবদান?
২৪ বলে ৩৪।
অনেকে বলবেন, এ আর এমন কী!
কিন্তু তাঁরা জানেন না, রিচার খেলার ধরনটাই ওই রকম।
সে ক্রিজে আসে অক্সিজেন সাপ্লাই কমে যাওয়া একটা দলকে নিবিড় পরিচর্যা দিতে নয়,
সে আসে ‘শক থেরাপি’ দিতে।
ওই ২৪টা বলই দক্ষিণ আফ্রিকার মনোবলকে ভেঙে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। ওই ইনিংসটা ছিল ছোট, কিন্তু তীব্র।
ঠিক যেন উত্তরের সেই কালবৈশাখী,
আসার আগে জানান দেয় না,
কিন্তু যখন আসে, তখন সব ওলটপালট করে দিয়ে যায়।
আর শুধু ব্যাট?
ওই উইকেটের পেছনে গ্লাভস হাতে মেয়েটাকে দেখেছেন?
চিতার মতো ক্ষিপ্র।
গোটা ম্যাচটা সে-ই তো পরিচালনা করে।
অধিনায়কের চেয়েও বেশি কথা বলে ওই কিপার।
রিচা শুধু একজন পাওয়ার-হিটার নয়,
সে একজন ধুরন্ধর মস্তিষ্কও বটে।

যখন মুম্বাইয়ের ডিওয়াই পাতিল স্টেডিয়ামে রিচা বিশ্বজয়ের ট্রফিটা ছুঁয়ে দেখছিল,
যখন সতীর্থদের সঙ্গে সেই বাঁধভাঙা উল্লাসে সে মত্ত,
তখন...
স্টেডিয়ামে উপস্থিত,
তার নিজের বাবা হয়তো নিঃশব্দে চোখ মুছছিলেন।
সঙ্গ দিয়েছিলেন তাঁর মা।
আজ তাঁর স্বপ্নটা মহিরুহ হয়েছে।
আজ তাঁর মেয়ে শুধু তাঁর মেয়ে নয়,
সে গোটা বাংলার গর্ব, গোটা দেশের অহংকার।
রিচা ঘোষ একটা নাম নয়।
রিচা ঘোষ একটা বিশ্বাসের নাম।
এই বিশ্বাস যে,
ছোট শহর কোনো বাধা নয়।
এই বিশ্বাস যে,
বাবার হাতটা শক্ত করে ধরলে যেকোনো দুর্গম পথই পার হওয়া যায়।
এই বিশ্বাস যে,
মেয়ে মানেই ‘ললিত’ শিল্প নয়,
মেয়ে মানে বারুদও হতে পারে।
মানবেন্দ্র ঘোষের সেই বাজিটা আজ সার্থক।
যে ব্যাটটা তিনি তাঁর সর্বস্ব বিক্রি করে কিনেছিলেন,
সেই ব্যাট আজ বিশ্বজয়ী।
কাঞ্চনজঙ্ঘা আজ হয়তো একটু বেশিই উজ্জ্বল।
কারণ, তাঁরই ঘরের মেয়ে আজ বিশ্বসেরা।