বাংলার মাঠ কাঁপাত যে খেলা

ছবি: এআই/বন্ধুসভা

মেঠো গ্রামীণ মাঠ। দুই দলের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে। মাঝখানে সাদা চুনে কিংবা দড়িতে আঁকা স্পষ্ট এক রেখা। যেন মাঠের মাঝখানে দুটি ভিন্ন ভূখণ্ড। এক তরুণ ধীরে ধীরে পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে অপর পক্ষের ভূখণ্ডে। মুখে একটি শব্দ উচ্চারণ করে এগিয়ে যাচ্ছে বারবার। একটু অসতর্ক হলেই ধরা পড়বে প্রতিপক্ষের হাতে। সঠিক সময়ে প্রতিপক্ষকে ছুঁয়ে, নিশ্বাস ফেলার আগেই আবার ফিরে আসতে হবে নিজের আঙিনায়।

এদিকে অপর দলের সবাই যেন চিৎকার করছে, ‘সাবধানে সাবধানে। একে ঘিরে ধর! যেন যেতে না পারে। ফিরতে দিবি না!’ তরুণটি হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ল। ছুঁয়ে দিল দুজনকে। এরপর শুরু করল দৌড়। একটু এগিয়ে যেতেই ছয়জন একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। শুরু হলো টানাটানি। তরুণটি নিজ সীমানায় ফিরতে পারলেই তার দল পাবে পয়েন্ট। না পারলে খেলোয়াড় হারাবে তারা।

অনেকেই জানে না কেন এটা জাতীয় খেলা! অথচ এই খেলা বহন করে আমাদের মাটি, ইতিহাস আর শিকড়ের গল্প।

মাঠের চারদিক সরগরম। বুড়ো থেকে কিশোর—সবাই মুগ্ধ দৃষ্টিতে খেলা দেখছে। কারও হাতে তালি, কারও মুখে চিৎকার। এই উত্তেজনা যেন ছড়িয়ে পড়েছে মাঠ ছাড়িয়ে গ্রামজুড়ে। এ যেন নিছক একটি খেলা নয়, নিখুঁত কৌশল আর দুর্দমনীয় সাহসের এক প্রদর্শনী।

এই খেলা আমাদের জাতীয় খেলা, হাডুডু। পোশাকি নাম হলো কাবাডি। ১৯৭২ সালে হাডুডু কিংবা কাবাডিকে বাংলাদেশের জাতীয় খেলা হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

এই খেলায় বল লাগে না, মাঠ লাগে সামান্য অথচ উত্তেজনায় ভরপুর। নিয়মও খুব সোজা—একজন আক্রমণকারী প্রতিপক্ষের মাঠে গিয়ে ছুঁয়ে দিয়ে ফিরে আসতে হবে, ছুঁয়ে দেওয়া খেলোয়াড়দের বাইরে পাঠানো হবে। আর সে নিজে ফিরে আসতে না পারলে আক্রমণ ব্যর্থ, আক্রমণকারী দল একজন খেলোয়াড় হারাবে।

একসময় হাডুডু ছিল আমাদের দেশের মানুষের জীবনের একটি অংশ। ১৯৮০-৯০ দশকেও দেশের প্রায় সব অঞ্চলে বিকেলবেলা মাঠ গমগম করত এই খেলায়। ঈদ, পয়লা বৈশাখ, হাটের মেলা কিংবা স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, যেকোনো উৎসবে ছিল হাডুডু। কালের স্রোতে সেটা এখন খুব একটা দেখা যায় না।

খুলনা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী এবং নরসিংদীসহ দেশের কিছু অঞ্চলে এখনো মাঝেমধ্যে টুর্নামেন্ট হয়। ২০২৩ সালেও স্থানীয় পর্যায়ে কয়েকটি প্রতিযোগিতা হয়েছিল। যদিও জাতীয় পর্যায়ে এর কোনো বড় আয়োজন চোখে পড়েনি।

হাডুডু খেলার উৎপত্তি ভারতীয় উপমহাদেশে। বিশেষ করে ভারতের তামিলনাড়ু অঞ্চলে। কাবাডি খেলার সূচনা নিয়ে অনেক গল্প শুনতে পাওয়া যায়। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, মহাভারতে এই খেলার অনুরূপ ঘটনা দেখা যায়, যেখানে শত্রুপক্ষকে ছুঁয়ে নিজ দলে ফিরে আসার কৌশল ছিল যুদ্ধনীতির অংশ। মূলত আত্মরক্ষা ও পাল্টা আক্রমণের কৌশলগত অনুশীলন থেকেই কাবাডির জন্ম।

এই খেলায় প্রয়োজন নেই জটিল সরঞ্জামের। জুতা নেই, বল নেই, দামি কোনো পোশাক লাগে না। দরকার কেবল ফাঁকা একটি মাঠ। কাবাডিতে প্রতি দলে ৭ জন খেলোয়াড় ও অতিরিক্ত ৫ জন খেলোয়াড় থাকে। দুই অর্ধে ছেলেদের ২৫ মিনিট করে এবং মেয়েদের ২০ মিনিট করে খেলা হয়। মাঝখানে ৫ মিনিট বিরতি থাকে। খেলা পরিচালনা করেন একজন রেফারি, দুজন আম্পায়ার এবং একজন স্কোরকিপার।

আজকের প্রজন্ম হাডুডুর নাম শুনে অবাক হয়। অনেকেই জানে না কেন এটা জাতীয় খেলা! অথচ এই খেলা বহন করে আমাদের মাটি, ইতিহাস আর শিকড়ের গল্প। বাংলাদেশে হাডুডুর জনপ্রিয় কয়েকজন খেলোয়াড় হলেন মিজানুর রহমান মিজান, লিটন আলী, আরিফ রব্বানী, আরুদুজ্জামান মুন্সি, মনিরুল চৌধুরী, ইয়াসিন আরাফাত, শাহ মোহাম্মদ শাহান, সবুজ মিয়া, রোমান হোসেনসহ আরও অনেকে। আমাদের জাতীয় খেলার তারকা তাঁরা। অথচ তাঁদের আমরা কতটুকুই–বা চিনি জানি!

বাংলাদেশ কাবাডি দল ২০০৬ এশিয়ান গেমসে ব্রোঞ্জ পদক পায়। ১৯৮০ সালে, প্রথম এশিয়ান কাবাডি চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ রানার্সআপ হয়। পরের এশিয়ান কাবাডি চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ আবারও রানার্সআপ হয়। ক্রিকেট-ফুটবলের মতো কাবাডিরও হয় বিশ্বকাপ। এই পর্যন্ত তিনটি আসর অনুষ্ঠিত হয়। সবগুলোতেই চ্যাম্পিয়ন হয় প্রতিবেশী দেশ ভারত।

প্রকৃতপক্ষে আমাদের জাতীয় খেলা নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে দেখার মতো তেমন উদ্যোগ চোখে পড়ে না। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পাওয়ার পরেও বিদেশি খেলার কাছে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী এ খেলা।

জাতীয় খেলা কেবল একটি নাম হতে পারে না। এটা শুধু জাতীয় পরিচয়ের বিষয় নয়। এটা সম্মানের, দেশের সংস্কৃতিও এর সঙ্গে জড়িত। সময় এসেছে হাডুডুকে বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে টেনে এনে আবার মাঠে ফেরানোর।

সাবেক সভাপতি, নোয়াখালী বন্ধুসভা