মাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ার পর কেয়ার সঙ্গে প্রথম পরিচয়। তখনো সেভাবে বন্ধুত্বের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়নি। কেয়া ছাত্রী হিসেবে মেধাবী হলেও তার আচরণে কেমন যেন গাম্ভীর্য ভাব ফুটে উঠত। তাই তার সঙ্গে সেভাবে কারও কথা বলার সাহস হতো না। আমার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ছিল না। একদিন ক্লাসে টিফিনের ফাঁকে সব সহপাঠী গল্পগুজবে মত্ত ছিলাম। কেয়াও উপস্থিত ছিল। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে কার বাসা কোথায়, এ বিষয় নিয়ে কথা হলো। সবাই সবার বাসার ঠিকানা জানাল। আমি জানালাম, আমার বাসা পাটগুদাম। কেয়া আমার উদ্দেশে উৎফুল্লকণ্ঠে বলে উঠল, ‘তোমার বাসা পাটগুদাম! আমার বাসাও তো ঐদিকেই। আমরা তো একসঙ্গেই যাতায়াত করতে পারি।’ জবাবে বললাম, ‘জেনে ভালো লাগল। হুম, একসঙ্গেই তো বাসায় যাওয়া যায়।’
সেদিন থেকেই কেয়ার সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গেল। তাকে যতটা কঠিন আর গাম্ভীর্য মনে করেছিলাম, ততটা সে নয়; তার মন কোমল। স্কুল শেষে একসঙ্গেই বাসায় ফিরতাম। তার বাসার এক গলি আগে আমার বাসা হওয়ায় সে আমাকে নামিয়ে দিয়ে যেত।
নবম শ্রেণিতে ওঠার পর শুরু হলো বিভাগ নির্বাচনের কার্যকারিতা। গণিতে একটু দুর্বল হওয়ার কারণে মানবিক বিভাগ বেছে নিলাম। কেয়া গণিতে বেশ ভালো। প্রথমদিকে বিজ্ঞান বিভাগ বেছে নিলেও পরবর্তী সময়ে সে মানবিক বিভাগে পড়ার সিদ্ধান্ত নিল। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘তুমি তো গণিতে ভালো রেজাল্ট করেছ। বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার জন্য একদম উপযুক্ত। তারপরও মানবিক বিভাগ নির্বাচন করলে কেন?’ জবাবে সে বলল, ‘হুম, গণিতে রেজাল্ট ভালো হয়েছে ঠিকই। কিন্তু আমার বিজ্ঞানে তেমন একটা টান নেই। ব্যবসায় শিক্ষা শাখাতেও তেমন আগ্রহ নেই। তাই মানবিক বিভাগে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।’
মানবিক বিভাগে আমরা সংখ্যায় কম হলেও ক্লাস করতে বেশ ভালোই লাগত। দশম শ্রেণিতে নির্বাচনী পরীক্ষার আগে ব্যবহারিক খাতা (যেসব বিষয়ের ব্যবহারিক ছিল) জমা দেওয়ার জন্য জানানো হলো। যেহেতু মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলাম, সেহেতু আমার ভূগোল ও কম্পিউটার শিক্ষা বিষয়ের ব্যবহারিক ছিল। কম্পিউটার ব্যবহারিক করার জন্য একটা ছোট গাইড বইয়ের কথা বলা হয়েছিল। আমার কাছে সেই গাইড বইটা ছিল না। কেয়ার বাসা কাছাকাছি হওয়ায় তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম গাইড বইটি আছে কি না। সে জানাল, তার কাছে গাইড বইটি আছে। আমি এক সপ্তাহের জন্য বইটি কেয়ার কাছ থেকে ধার নিলাম।
কেয়া আমাকে তাদের প্রতিবেশীর মোবাইল নম্বর দিয়েছিল। তার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য সেই নম্বরই ছিল ভরসা। বইটি ফেরত দেওয়ার আগে ভাবলাম, ওই নম্বরে ফোন করে তাকে জানাই। ফোন করার পর ফোনের ওপাশ থেকে পুরুষ কণ্ঠ ভেসে এল। পরিচয় দেওয়ার পর ভদ্রলোক কিছু বুঝতে না পেরে ফোন কেটে দিলেন। বুঝলাম, সম্ভবত ভদ্রমহিলা বিষয়টা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। কেয়া মহাবিপদে ফেলে দিল!
মনে পড়ল, একবার রিকশা দিয়ে আসার সময় দেখেছিলাম পল্লব নামের এক লোককে কেয়া ‘মামা’ বলে সম্বোধন করছিল। পল্লব মামা আমাদেরও দূরসম্পর্কের আত্মীয় হন। ওনার বাসাও কাছাকাছি হওয়ায় বাবার সঙ্গে সেখানে গেলাম। পল্লব মামাকে কেয়ার বাসা কোথায় জিজ্ঞাসা করলাম। কেবল জানি, এলজিইডি ভবনের পাশের গলিতে কেয়াদের বাসা। পল্লব মামাকে মনে করাতে চেষ্টা করলাম, কেয়া একবার আমার সামনে আপনাকে ‘মামা’ বলে ডেকেছিল।
সম্বিত ফিরে পেয়ে মামা বললেন, ‘আমাকে তো একজনই “মামা” বলে ডাকে। তুমি কি তার কথাই বলছ নাকি?’
আমি কিছু বললাম না। ভাবলাম, ওই একজন কি কেয়া হতে পারে?
হাঁটতে হাঁটতে একটা গলির পথ ধরলাম। একটা লম্বা গাছ পার হতেই তিন-চারটা হাফ বিল্ডিং। তারই এক বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে পল্লব মামা ‘রিভা আপা’ বলে ডাক দিতেই এক ভদ্রমহিলা বের হয়ে এলেন। ওনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেয়াদের বাসা কোথায়?’ ভদ্রমহিলা স্মিত হেসে জবাব দিলেন, ‘আমি কেয়ার মা। সে ভেতরে আছে। এসো ভেতরে এসো।’ আমরা ভেতরে গেলাম। কেয়াকে বইটা ফেরত দিলাম। সেখানে অনেকক্ষণ বসলাম। আলাপচারিতায় জানতে পারলাম, তারা আমার এক চাচির নিকটাত্মীয় হয়। কেয়ার মা চাচির খালাতো কী মামাতো বোন হন। সেদিক বিবেচনায় চাচি সম্পর্কে কেয়ার খালা হয়।
আমি আর কেয়া একই কলেজে ভর্তি হই। দুই বছরের কলেজজীবনটা দুর্দান্ত কেটেছে। একবার কলেজে শিক্ষাসফরের জন্য স্থান নির্ধারণ করা হলো ফ্যান্টাসি কিংডম। ফোনে তখনো ক্যামেরার সুবিধা ছিল না। তাই শিক্ষাসফরে ছবি তোলার জন্য ডিএসআরএলের ক্যামেরাই ভরসা। চার দলের মধ্যে কেয়াই প্রথমে ক্যামেরার দায়িত্ব নেয়। কিন্তু শিক্ষাসফরের এক দিন আগেই সে বলে যে, তার ক্যামেরা নষ্ট হয়ে গেছে। বাকি দুজন ক্যামেরার ব্যবস্থা করতে পারবে না বলে জানায়। সবার নজর আমার দিকে। অগত্যা আমাকেই ক্যামেরার ব্যবস্থা করতে হলো।
অনার্স পর্যায়েও আমরা একই কলেজে অধ্যয়ন করেছি। তবে আমাদের বিভাগ ছিল আলাদা। কেয়া ইংরেজি বিভাগে আর আমি বাংলা বিভাগে। প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নকালে কিছু বিষয় কমন থাকায় কেয়ার সঙ্গে দেখা হতো। পরের বর্ষগুলোয় তার সঙ্গে খুব একটা দেখা হতো না। কেবল দু–একবার কলেজে অনুষ্ঠিত পহেলা ফাগুন কিংবা বৈশাখের অনুষ্ঠানে দেখা হয়। সেবার আমরা পুরো ক্যাম্পাস ঘুরেছিলাম। বকুলতলায় জম্পেশ আড্ডা দিয়েছিলাম। সেই ফেলে আসা স্মৃতিময় অধ্যায়গুলো কতই না মধুর ছিল!
সেই মধুর স্মৃতিগুলো হয়তো ফিরে পাব না। কিন্তু সেই বন্ধুকে হারাইনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখনো আমাদের যোগাযোগ হয়।
৩৭, আকুয়া জুবিলী কোয়ার্টার, ময়মনসিংহ