দিনের পর দিন চলতে থাকা এই নিঃসঙ্গ যাত্রায়, যদি এমন একজনের দেখা মেলে, যার পাশে নিজের ভঙ্গুরতাও প্রকাশ করা যায়; যাকে কিছু না বললেও সে বুঝতে পারে—সে মানুষটিই বন্ধু।
বন্ধুত্ব অসাধারণ এক অনুভূতির নাম। যার কথা মনে পড়লে আরাম অনুভব হয়। এক টুকরা স্বস্তি অনুভব হয়। মনে হয়, নির্ভরতার জায়গা।
আমাদের চারপাশে বহু মানুষ থাকে—কর্মস্থলে, পরিবারে, পরিচিতজনের ভিড়ে। কিন্তু এদের মধ্যে কয়জনের সামনে আমরা সত্যিকারের ‘আমি’ হয়ে দাঁড়াতে পারি? আমরা মুখে হাসি রাখি, কিন্তু ভেতরে ব্যথা চেপে রাখি। সামাজিকতা রক্ষা করতে গিয়ে নিজেদের চাওয়াগুলো ভুলে যাই। দিনের পর দিন চলতে থাকা এই নিঃসঙ্গ যাত্রায়, যদি এমন একজনের দেখা মেলে, যার পাশে নিজের ভঙ্গুরতাও প্রকাশ করা যায়; যাকে কিছু না বললেও সে বুঝতে পারে—সে মানুষটিই বন্ধু।
বন্ধুত্ব কোনো চুক্তিপত্র নয়, বরং এটি এক অনুচ্চারিত বোঝাপড়ার নাম। এমন এক সম্পর্ক, যেখানে মুখোশ পরার দরকার নেই। যেখানে ভুল করলে তিরস্কার নয়, সহানুভূতি মেলে। যেখানে শুধু সাফল্য উদ্যাপন নয়, ব্যর্থতার কাঁধে মাথা রাখার জায়গাও থাকে।
বন্ধুত্বের শুরু, বিস্তার আর সীমা
বন্ধুত্ব শুরু হয় অদ্ভুত এক অনুরণন থেকে—কারও কথা, চাহনি কিংবা ভাবনার সঙ্গে নিজের মনের মিল খুঁজে পাওয়ার মধ্য দিয়ে। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে বিশ্বাস, নির্ভরতার ভাব ও নিরাপত্তা। একসময় সেই সম্পর্ক এতটাই গভীর হয়ে ওঠে, যেখানে ‘তুই থাকলে আমি নিরাপদ’ অনুভব তৈরি হয়।
তবে গভীরতা মানেই অবারিত প্রবেশাধিকার নয়। প্রতিটি সম্পর্কের মতো বন্ধুত্বেও কিছু সীমানা থাকা জরুরি। মানসিক স্বাস্থ্য, ব্যক্তিগত স্পেস, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা—এ সবই সম্পর্কের সুস্থতা নিশ্চিত করে।
বন্ধুত্বের সীমানা মানে কখনোই দূরত্ব নয়, বরং সম্মান ও স্বীকৃতির জায়গা। আমরা যেমন নিজের কষ্ট প্রকাশ করতে পারি, তেমনি না বলার অধিকারও রাখি। এ ভারসাম্যই বন্ধুত্বকে টিকিয়ে রাখে।
স্বাস্থ্যকর বনাম অস্বাস্থ্যকর বন্ধুত্ব
একটি স্বাস্থ্যকর বন্ধুত্ব বুঝতে সময় লাগে না। সেখানে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে হয় না। এই সম্পর্কে আপনি শুনতে পান, বোঝা হয় এবং সঙ্গীর উন্নতিতেও ঈর্ষা নয়—গর্ব জাগে। সে আপনাকে প্রশ্ন করে না ‘তুমি কেন এমন?’, বরং জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি ঠিক আছ তো?’
অন্যদিকে অস্বাস্থ্যকর বন্ধুত্ব সম্পর্কের ছায়ায় বিষ ছড়ায়। যদি সব সময় অপরাধবোধে থাকেন, নিজেকে ছোট মনে হয়, বন্ধুর সামনে নিজের মত প্রকাশ করতে ভয় পান, তবে তা বন্ধুত্ব নয়, একধরনের আবেগনির্ভর গ্যাঁড়াকল।
অনেকেই বোঝে না কখন একটি বন্ধুত্ব বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। কারণ, আমরা ‘বন্ধু’ শব্দটিকে এতটা পবিত্র ধরে নিই যে সেটিকে প্রশ্ন করাটাকেই যেন অপরাধ মনে হয়।
কখন সম্পর্ক থেকে সরে আসতে হবে
বন্ধুত্বের অর্থ আত্মত্যাগ নয়। যদি একটি সম্পর্ক আত্মসম্মান নষ্ট করে, মানসিক স্বাস্থ্যে আঘাত করে, তবে সেই সম্পর্ক থেকে সরে আসাই শ্রেয়। এটি কোনো ‘নেগেটিভ’ সিদ্ধান্ত নয়, বরং নিজের প্রতি যত্নের একটি সাহসী পদক্ষেপ।
বন্ধুত্ব মানে দায় নয়, ভালো থাকা এবং অন্যকে ভালো রাখতে পারা। এটি শুধু অন্যকে নিয়ে ভাবা নয়, নিজেকেও প্রশ্ন করা—‘এই সম্পর্ক কি আমাকে ভালো রাখছে?’
বন্ধু দিবসে আমরা কেবল অন্যের বন্ধু হব না, নিজেরও বন্ধু হব। নিজেকে জিজ্ঞেস করব, ‘আমার পাশে এমন কেউ আছে কি, যার কাছে আমি “আমি” হয়ে থাকতে পারি?’ যদি এমন কেউ থেকে থাকে, তাহলে তাকে ধরে রাখুন সম্মানে, কৃতজ্ঞতায়, ভালোবাসায়। এমন বন্ধুত্বই জীবনের সবচেয়ে বড় আশ্রয়।
বন্ধুত্ব থাকুক হৃদয়ের কেন্দ্রজুড়ে—চাপাহীন, মুখোশহীন এবং নিঃশর্ত।
লেখক: সাইকোথেরাপিস্ট ও মানসিক বিষয়ক প্রশিক্ষক, কনসালট্যান্ট, সিটি হসপিটাল লিমিটেড এবং সভাপতি ঢাকা মহানগর বন্ধুসভা।