মানসিক স্বাস্থ্যে হেট স্পিচের প্রভাব ও মুক্তির উপায়

বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে দ্রুত ছড়ানো ও ক্ষতিকর সামাজিক সমস্যাগুলোর একটি হলো হেট স্পিচ অর্থাৎ ঘৃণামূলক ভাষা বা বক্তব্যছবি: এআই/বন্ধুসভা

হেট স্পিচ মানে এমন কথা, লেখা বা প্রকাশ, যা কাউকে তার ধর্ম, জাতি, ভাষা, লিঙ্গ বা সমাজের প্রান্তিক অবস্থানের কারণে ঘৃণার লক্ষ্যবস্তু বানায়। এটি ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রতি সহিংসতার জন্ম দিতে পারে। আরও সহজ করে বললে এটি এমন এক আচরণ, যা ব্যঙ্গভাবে প্রকাশ করা হয়। এমন ভাষা, লেখা বা প্রকাশ, যেখানে কারও জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, ভাষা, যৌন পরিচয়, মতাদর্শ বা অন্য কোনো পরিচয়ের কারণে তাকে অবজ্ঞা, অপমান বা সহিংসতার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। সরাসরি সেটা হতে পারে গালি, বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য, পরোক্ষভাবে উপহাস, ব্যঙ্গ করা ছবি ও কটাক্ষ করে কথা বলা; হতে পারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কমেন্টস, ভিডিও ও মিম।

বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে দ্রুত ছড়ানো ও ক্ষতিকর সামাজিক সমস্যাগুলোর একটি হলো হেট স্পিচ অর্থাৎ ঘৃণামূলক ভাষা বা বক্তব্য। এটি শুধু সমাজে বিভাজন তৈরি করে না, ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি ও গভীর প্রভাব ফেলে।

মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর হেট স্পিচের প্রভাব
• আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মান ধ্বংস হয়: ঘৃণামূলক বক্তব্য বারবার শুনতে শুনতে একজন ব্যক্তি নিজেকে তুচ্ছ, অযোগ্য বা অসহায় ভাবতে শুরু করে। এতে আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়ে।
• দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ ও উদ্বেগ: হেট স্পিচ ব্যক্তিকে মানসিকভাবে আতঙ্কে রাখে। সে কখন, কোথায়, কার কাছ থেকে আক্রমণ আসবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগে।
• ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা: নিজেকে বারবার টার্গেট জায়গায় দেখলে মনে হয়, সে সমাজে অনাকাঙ্ক্ষিত। এতে ধীরে ধীরে ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনের লক্ষণ দেখা দেয়। যেমন খাওয়া–ঘুমের অনিয়ম, আনন্দহীনতা, নিজেকে আঘাত করার প্রবণতা ইত্যাদি।
• আত্মহত্যার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া: অতিরিক্ত অপমানিত বোধ করায় কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ পর্যন্ত বেছে নেয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এই প্রবণতা অনেক বেড়েছে।
• সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়া: ঘৃণামূলক বক্তব্য বারবার শুনতে শুনতে কেউ কেউ নিজেকে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। অন্য মানুষের সঙ্গে খুব একটা মেশে না।

হেট স্পিচের শিকার ব্যক্তিরা অনেক সময় সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক দুর্বল হয়ে যায়। এতে একাকিত্ব বাড়ে, যা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।

হেট স্পিচের মানসিক প্রভাব থেকে মুক্তির উপায়
নিজের কষ্ট শেয়ার করা (ভেতরে চাপা না রাখা)।
কাউকে বিশ্বাস করা—বন্ধু, পরিবার, শিক্ষক বা পেশাদার কাউন্সেলর।
মনোস্বাস্থ্যসেবা নেওয়া। প্রয়োজন হলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, সাইকোলজিস্ট বা কাউন্সেলরের সাহায্য নেওয়া।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে সাময়িক বিরতি নেওয়া।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘৃণামূলক কমেন্ট বা পোস্ট দেখে নিজেকে বিরত রাখা। অর্থাৎ যে কমেন্টটা কষ্ট দেয়, সেটা দেখা থেকে নিজেকে বিরত রাখা।
যারা সম্মান করে এবং বোঝে, সেই রকম বন্ধুবান্ধব বা গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হওয়া। এটা মানসিক প্রশান্তি দিতে পারে।
নিজের যত্ন ও নিজেকে ভালোবাসার দিকে খেয়াল করা। নিজের যত্ন নিজে করলে মানসিক প্রশান্তি আসে।
মেডিটেশন, যোগব্যায়াম, জার্নাল লেখা, গান শোনা, ছবি আঁকা, প্রকৃতিতে সময় কাটানো ইত্যাদি করা যায়।
প্রতিদিন নিজের সম্পর্কে নিজেকে ভালো কিছু কথা বলা। এমনভাবে বলা, যেন সেটা কান, মন ও সারা শরীরে ছড়িয়ে যায়। কথাগুলো হতে পারে, ‘আমি ভালোবাসার যোগ্য’, ‘আমি আমাকে ভালোবাসি’, ‘আমি দক্ষ’, ‘আমি যেমন আছি, তেমনি ঠিক আছি’, ‘আমি পারি’ ইত্যাদি।
নিজেকে ক্ষমা করতে শেখা।
কোনো সমস্যায় পড়লে বা হেট স্পিচের শিকার হলে কারও সহযোগিতা চাওয়া। সহযোগিতা চাওয়াটা দুর্বলতা নয়; বরং এটি সাহস ও নিজের প্রতি দায়িত্বশীলতার পরিচয়।

লেখক: সাইকোথেরাপিস্ট কনসালট্যান্ট, ঢাকা সিটি হাসপাতাল ও সভাপতি, ঢাকা মহানগর বন্ধুসভা।