মানবসত্তার স্বাভাবিক গতি ও ধারা বহমান রাখতে মানসিক প্রশান্তি ও চিত্তবিনোদনের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। এ কথা চিরসত্য যে স্বাস্থ্যকর উপায়ে বিনোদনের মাধ্যমে মানুষের প্রাণ জীবন্ত হয়ে ওঠে, কর্মস্পৃহা সৃষ্টি হয়, ক্লান্তি-গ্লানি দূর হয়। অন্যদিকে অস্বাস্থ্যকর বিনোদন ক্লান্তি, অস্থিরতা, চাপ এবং মনের মধ্যে একধরনের অশান্তি তৈরি করে।
মানুষ এখন অনেক ব্যস্ত। কর্মক্ষেত্র, পড়াশোনা—নানাবিধ কার্যক্রম নিয়ে সবাই ব্যস্ত থাকেন। সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং সামাজিক দৌরাত্ম্য বজায় রাখতে সবার মধ্যে এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতা চলে। এসব করতে গিয়ে মানুষ পরিবার, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে সময় কাটানো প্রায় ভুলে যাচ্ছেন। যতটুকু হয়, সেটা অনলাইনে ভার্চ্যুয়ালি খোঁজখবর নেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
যখন আমরা নেতিবাচক কিছু দেখি বা পড়ি, তা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এর নেতিবাচক প্রভাব বেশি পড়ে।
ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের কল্যাণে এখন ভার্চ্যুয়াল জগৎ হাতের মুঠোয়। বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে এটাকেই অধিকাংশ মানুষ বেছে নেন। মোবাইলের মাধ্যমে মুহূর্তেই সহজভাবে অনেক কিছুর কাছাকাছি পৌঁছানো যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে ডুবে থাকা, ইউটিউবে ভিডিও দেখা, অনলাইন গেমস খেলা, টিকটক ও রিলস দেখাতেই মানুষ সময় কাটিয়ে দেন। এসব মাধ্যমে বিনোদনের পাশাপাশি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া এবং দেশ-বিদেশের সব খবরাখবর পাওয়া যায়।
তবে আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কেবল বিনোদনের ক্ষেত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বিশেষ করে ফেসবুকে একের পর একে নেতিবাচক তথ্যের ছড়াছড়ি। আগে যেটি ছিল বিনোদনের মাধ্যম, সেটাই এখন হয়ে উঠেছে অস্থিরতা, হতাশা, উদ্বিগ্নতা, ভয় ও আতঙ্কের কারণ। যার প্রভাব পড়ছে আমাদের চিন্তাচেতনায়, আঘাত হানছে অনুভূতিতে। কেউ কেউ হয়ে উঠছেন বিবেকহীন, মেজাজি, অস্থির, অন্যমনস্ক, কমে যাচ্ছে আত্মবিশ্বাস। ভেতরে জন্মাচ্ছে অসন্তুষ্টি।
যখন আমরা নেতিবাচক কিছু দেখি বা পড়ি, তা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এর নেতিবাচক প্রভাব বেশি পড়ে। হতে পারে ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি। এমনকি কেউ কেউ নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে ফেলেন, যা আমাদের ভালো থাকাকে থামিয়ে দেয়।
এত কিছুর ভিড়ে মানুষ ভুলে যাচ্ছেন বিনোদন মানে কী! কী করলে আনন্দ পাওয়া যায়! এর জন্য আমাদের জানতে হবে, কোন কাজটা আমাকে আনন্দ দিচ্ছে, উৎফুল্ল ও প্রস্ফুটিত করছে, রিল্যাক্স করছে; আর কোন কাজটা বিষণ্নতায়, হতাশায় নিমজ্জিত করছে। জানতে হবে আমাদের সীমানা। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কতটুকু, কীভাবে ব্যবহার করব? কোন খবরগুলো, কোন তথ্যগুলো ব্যক্তি আমার জন্য দরকারি? জানতে হবে কোথায় এবং কখন থামতে হবে।
মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে যা করণীয়—
• ডিভাইস বা মোবাইল ব্যবহারের নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা। এ ক্ষেত্রে মোবাইলে রিমাইন্ডার দিয়ে রাখা যেতে পারে।
• ফ্রেন্ডলিস্টে কেবল পরিচিত মানুষগুলোকে রাখা। বিশেষ করে যাঁদের সঙ্গে আপনার পছন্দ-অপছন্দগুলো মেলে। তাহলে নেচিবাচক পোস্ট খুব কম সামনে আসবে।
• মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলছে, এমন ক্ষতিকর অ্যাপ ব্যবহার না করা।
• যে খবরগুলো অস্থির করে তোলে, মনে ভয় বা চাপ তৈরি করে, সেগুলো এড়িয়ে চলা।
• সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেকোনো তথ্য দেখে অস্থির না হয়ে সেগুলোর সত্যতা যাচাই করা।
মনে রাখতে হবে, সব তথ্য আপনার জন্য প্রযোজ্য নয়। নিজের মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ করা শিখতে হবে। নিজের ভালো থাকাটা নিজের ওপরই নির্ভরশীল। বিশ্বাস করতে হবে, আমি আমাকে ভালো রাখতে পারি। যদি তা বুঝতে কেউ ব্যর্থ হন, তাহলে প্রয়োজনে শারীরিক বা মানসিক ডাক্তার অথবা পেশাদার সাইকোথেরাপিস্টের শরণাপন্ন হতে হবে।
লেখক: সাইকোথেরাপিস্ট কনসালট্যান্ট, ঢাকা সিটি হাসপাতাল এবং সভাপতি, ঢাকা মহানগর বন্ধুসভা।