আমরা কি সত্যিই ভালোবাসতে ভুলে যাচ্ছি, নাকি শুধু ভয় পাচ্ছি
অদ্ভুত এক ভারী, নীরব বিষণ্নতা ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের ঘিরে। প্রযুক্তিগত এত উন্নতির মধ্যেও যেন আমাদের সম্পর্কগুলো হয়ে উঠছে ফ্যাকাসে, মন আঁকড়ে ধরছে কোনো নিদারুণ শূন্যতা। সামাজিক অগ্রগতি যেন উল্টো নিঃসঙ্গ করে তুলছে আমাদের। অসীম দীর্ঘ বিরতির ভিড়ে ম্লান হয়ে চলেছে আমাদের ভালোবাসা, বন্ধুত্ব বা যেকোনো আত্মিক সম্পর্ক।
আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় দেখা গেছে, তরুণদের মধ্যে এখন মানসিক ক্লান্তি, অবিশ্বাস ও আবেগগত অবসাদের মাত্রা তীব্রভাবে বিরাজ করে। কারণ, এই প্রজন্ম বড় হয়েছে অনিশ্চয়তাকে সঙ্গী করে; ভাঙাচোরা পরিবার, দীর্ঘস্থায়ী আর্থিক চাপ, ভারসাম্যহীন সামাজিক কাঠামো আর বিশ্বজোড়া অস্থিরতার মধ্যে। তারা তাদের পুরোনো ক্ষত আর দাগ বুকে বয়ে নিয়ে হাঁটে অবিরত; বহু ছোট ছোট হতাশার টানা আঘাতে গঠিত দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত সেগুলো, যাতে নেই কোনো রক্তের দাগ, নেই নাটকীয়তা। তাই যখন সত্যিকারের ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা খুব কাছে এসে ধরা দেয়, মন যেন অকারণেই পিছিয়ে যায়।
অনুভূতি ভুল বলে নয়, বরং স্নায়ুতন্ত্রের পুরোনো শিক্ষা ‘সাবধান থেকো’–কে হৃদয় স্বভাবত আঁকড়ে থাকে বলে। মনোবিজ্ঞানীরা একে বলেন ‘ট্রমা-অওয়্যার লাভ’; এমন এক ভালোবাসা, যা আসে ভয়ের ভেতর দিয়ে, অতিরিক্ত সতর্কতার ছায়া মেখে। নতুন কোনো সম্পর্ক মানেই যেন নিজের ভেতরের পুরোনো ক্ষতগুলোর সঙ্গেই নতুন করে দর কষাকষি, কে কাকে কতদূর স্পর্শ করতে দেবে, তার এক অসম হিসাব।
এরপর আসে আধুনিক জীবনের তীব্র গতি, যা সম্পর্কগুলোর ওপর আরেক স্তর ভার রেখে যায়। আমাদের পূর্ব প্রজন্মের ভালোবাসা ছিল ধীর নদীর মতো; চিঠির কালি শুকাতে শুকাতে গভীর হতো সম্পর্কগুলো, সেখানে ভাগাভাগির জীবনে একসঙ্গে থাকার মানেই ছিল চিরজীবনের নিশ্চয়তা। অথচ আজকের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় স্ক্রিনে, দৌড়ে চলে ভয়ঙ্কর এক রাক্ষসিক গতিতে; আবার গভীরতার ভান ধরে সেই দৌড়েই চ্যাম্পিয়ন হয়ে স্ক্রিনেই মিলিয়ে যায় নিমেষে। এর কোনো নিজস্ব ধীর লয় নেই, নেই স্থিরতা, নেই স্থায়িত্ব। অর্থহীন ও বেপরোয়া প্রতিযোগিতায় নিজের জায়গা ঠিক রাখতে সে আবদ্ধ হয়ে থাকে নিজের ভেতরেই। তার ওপর রোগবালাইয়ের ভার এই লড়াইকে আরও কঠিন করে তোলে। দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা বা দুঃসহ ক্লান্তি মানুষের স্বাভাবিক আবেগীয় ভারসাম্যকেও নষ্ট করে ক্রমাগত। সে যতই যত্নশীল হোক, নিয়মিতভাবে সম্পর্ক সামলানোর মতো শক্তি বা আগ্রহ আর অবশিষ্ট থাকে না। তখন সে পিছু হটে, নীরবে দূরে সরে যায়। উদাসীনতা থেকে নয়, বরং নিজের ভেতরের ভাঙা অংশগুলোকে রক্ষা করার স্বতঃসিদ্ধ দায় থেকে।
তবে সব ধর্ম, সব দর্শনই এই দুর্বলতাকে মানুষের মৌলিক মানবিকতা বলেই স্বীকার করেছে। স্বীকার করেছে কোমলতার চরম মানবিক প্রমাণ হিসেবে। শিক্ষা দিয়েছে একে সহমর্মিতার সঙ্গে দেখার।
ইসলামে হৃদয়কে বলা হয়েছে ‘আমানত’, এক পবিত্র দায়িত্ব। নবীজি মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘তোমার শরীরের ওপর তোমার অধিকার আছে’। (সহিহ আল-বুখারি ৫১৯৯)। অতএব, নিজের আত্মাকে রক্ষা করা যেমন দায়িত্ব, তেমনি অন্যের আত্মাকে আঘাত না দেওয়াও গুরুদায়িত্ব। খ্রিষ্টধর্মে বলা হয়েছে, ‘সবকিছুর আগে হৃদয়কে রক্ষা করো। কারণ, জীবন তার থেকেই প্রবাহিত হয়।’ (প্রোভার্বস ৪:২৩)।
সুতরাং, হৃদয়কে রক্ষা করা মানেই পালিয়ে যাওয়া নয়, বরং ভেঙে না পড়ার ছোট ছোট, নীরব চেষ্টা। হিন্দুধর্মের ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে, ‘যে মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তার কাছে মনই শত্রু হয়ে ওঠে।’ (বিজি ৬:৬)।
সত্যিই, সব আস্থা ও আধ্যাত্মিকতার পথ শেষমেশ এক জায়গায় এসে থামে। স্মরণ করিয়ে দেয়, একটা স্থির মনই হতে পারে আত্মার সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়।
হয়তো আজ এই কারণেই আধুনিক সম্পর্কগুলো হয়ে ওঠে অন্তঃসারশূন্য। শুরু হতে না হতেই শেষ হয়ে যায় অনুভূতির তীব্রতা, অস্থিরতা ও অগোছালো স্বভাবের নিষ্ঠুর পরিহাসে; যেখানে উদাসীনতা কেবলই একটা ভয়ের মুখোশ, আবেগীয় অবশতার চিহ্ন। তবে সত্যিটা এখানেই; সব যন্ত্রণার মধ্যেও মানুষের নিরাপদ একটা ভালোবাসার জায়গা, শান্তির আশ্রয়ের আকাঙ্ক্ষা কখনই পুরোপুরি মরে যায় না। হৃদয়ের চাহিদাগুলো এখনো সেই একই, সময়ের সঙ্গে শুধু বেশ বদলেছে। এমন এক দুনিয়ায়, যেখানে সবকিছু তাকে পদে পদে অসাড় করে দিতে ফাঁদ পেতে বসে থাকে, সেখানে সততার সঙ্গে দাঁড়িয়ে মনকে হেফাজতের প্রচেষ্টা এক অসীম সাহসের জানান দেয়। এত বিশৃঙ্খলা আর জটিলতার মধ্যেও পরিপূর্ণভাবে নিজের ভেতরের অনুভূতিগুলোকে অনুভবের যে সজ্ঞান সিদ্ধান্ত, এটাই মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি।
মনে রাখা জরুরি, অনুভূতিহীনতা কখনো আমাদের ঠিকানা ছিল না, আর যেন কোনোদিন না হয়।
শিক্ষার্থী, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ