সম্পর্কে জড়াই, আবার সরে যাই—কেন?
আমি খুব দ্রুত সম্পর্কে জড়িয়ে যাই। সম্পর্কটা প্রথম দিকে খুবই ভালো থাকে। সারাক্ষণ মানুষটির সঙ্গে কথা বলা, তার সান্নিধ্য পেতে ইচ্ছা করা, একসঙ্গে ঘুরে বেড়ানো—সবকিছু ভালো লাগে। কথা না বলতে পারলে ভালো লাগে না। মনে হয় জীবনে সে না থাকলে হয়তো বেঁচে থাকতে পারব না। কিন্তু যখন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তখন দ্বিধায় থাকি, আমি কি সঠিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছি? এখন যেমন সম্পর্কটা তেমন করে কি সে সব সময় যত্ন নেবে, নাকি বদলে যাবে? চিন্তাগুলো যখন মাথায় খেলা করা শুরু করে তখনই সম্পর্ক থেকে বের হয়ে যেতে ইচ্ছা করে। ধীরে ধীরে মানুষটির সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে শুরু করি। যোগাযোগ কমিয়ে দিই। পরবর্তী সময়ে সম্পর্কটা আর থাকে না। কিছুদিন ভীষণ মন খারাপ থাকে। কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে না। মনে হয় আমার জন্য সম্পর্ক নয়। কিছুদিন পর আবার আরেকজনকে ভালো লাগে।
আমাদের মধ্যে অনেকেই এই অনুভূতির ভেতর দিয়ে যায়। যা কারও সঙ্গে শেয়ার করা হয়ে ওঠে না। এই অনুভূতিগুলো গভীর। যদি এ ঘটনার আরেকটু গভীরে প্রবেশ করি, তাহলে বোঝা যাবে আসলে কেন মানুষ বারবার এমন অনুভূতির মধ্যে পড়ে!
যে কারণে এমন অনুভূতির সৃষ্টি হয়
এ সমস্যায় যাঁরা ভুগছেন তাঁরা খুব আবেগপ্রবণ ও সংবেদনশীল। নতুন কারও সান্নিধ্য, যত্ন, কথাবার্তা—একধরনের নেশার মতো কাজ করে। তখন তীব্রভাবে আবেগপ্রবণ হয়ে যায়। মনে হয় এ মানুষটা ছাড়া বাঁচব না। তখন শরীরে দুটি হরমোনের হঠাৎ বৃদ্ধি হয়। যা আনন্দ, সুখ ও ভালোবাসার অনুভূতি তৈরি করে। তবে এ অধ্যায়টি দীর্ঘস্থায়ী নয়। ধীরে ধীরে আবেগ কমে আসে।
একদিকে ছেড়ে যাওয়ার ভয় হয়। অন্যদিকে মন চায় আরও গভীর সংযোগ। মন বলে, ‘যদি আমি খুব বেশি জড়িয়ে যাই, আর সে চলে যায়, তাহলে আমি ভেঙে পড়ব।’ তাই যখন সম্পর্ক সিরিয়াস হয়, তখন ভেতরের অবচেতন ভয় কাজ করে— ‘আমি কি ভুল করছি?’ ‘সে যদি বদলে যায়?’ ‘এই সম্পর্ক কি থাকবে?’ ঠিক তখনই দম বন্ধ লাগে, পালাতে ইচ্ছা করে, এবং দূরত্ব তৈরি হয়।
আমাদের সবার ভেতরেই একটি ছোট্ট শিশু লুকিয়ে আছে। যে শিশুটি ছোটবেলায় সব সময় চেয়েছে কেউ তাকে ভালোবাসুক, বুঝুক। কিন্তু সে কখনো পুরোপুরি নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য ভালোবাসা পায়নি। এই চিন্তা, অনুভূতি সেখান থেকেই আসে। শিশুটি এখনো খুঁজে ফেরে সেই ভালোবাসা। তার মন বলে—‘আমাকে একটুও ছাড়বে না।’ কিন্তু যখনই সেটা মেলে, সে ভয় পেয়ে ছুটে পালায়।
করণীয়
মনকে বলতে হবে, প্রেম মানেই দমবন্ধ হওয়া নয়। যখনই দমবন্ধ লাগা অনুভব হবে, তখন আসলে মস্তিষ্ক বলে, ‘এই ঘনিষ্ঠতা আমার জন্য বিপজ্জনক।’ কারণ, সে আগে এমন ঘনিষ্ঠতায় কষ্ট পেয়েছে। এই পুরোনো বিশ্বাসগুলো চিহ্নিত করতে হবে। মনকে জিজ্ঞেস করতে হবে, ‘এই মুহূর্তে আমি কি প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে সম্পর্ক চাই, নাকি ভেতরের শিশুমনটি ভালোবাসা চাচ্ছে?’ তখন সেই অনুভূতিগুলো চিঠিতে বা ডায়েরিতে লিখে ফেলা যায়। হালকা লাগবে। কারণগুলো বের হয়ে আসবে। প্রেমে পড়লে ধীরে ধীরে এগোতে হবে।
নিজেকে নিচের প্রশ্নগুলো করে জানতে হবে কী চাইছি বা কী খুঁজছি
• কাকে খুঁজি?
• সম্পর্ক থেকে কী চাই?
• কিসে ভয় পাই?
• কেমন সম্পর্ক চাই?
• পুরোনো প্যাটার্ন ধরে নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করা। শেষ সম্পর্কগুলোর শুরু, মাঝপথ, শেষ কেমন ছিল? মিল কোথায়? কিসে টান লেগেছিল? কিসে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল?
প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়ার পর নিজের সঙ্গে শপথ করতে হবে, কাউকে ভালো লাগলে তাড়াহুড়া করা যাবে না। সবার আগে নিজেকে ভালোবাসতে শিখতে হবে। নিজেকে বুঝতে হবে। নিজের চাওয়া পাওয়া বুঝতে হবে যে ‘আমি আসলে কী চাই?’ নিজেকে বলতে হবে, ‘আমি ভুল বা অযোগ্য নই।’
মনে রাখবেন, আপনি গভীরভাবে ভালোবাসতে চান এবং সেটাই আপনার শক্তি। এই শক্তিকে একটু যত্ন করুন, নিজের একান্ত ভেতরের কথাগুলো শুনুন। আগে নিজেকে পুরোপুরি জানতে হবে, যাতে প্রেমে না হারান। সম্পর্ক মানেই মানুষের সঙ্গে মানুষের একটি সংযুক্তি বা আন্তসম্পর্ক; যা আবেগ, বিশ্বাস, সম্মান ও যোগাযোগের মাধ্যমে গড়ে ওঠে। সম্পর্ক মানেই হচ্ছে নির্ভরতা, আস্থা এবং নিরাপদের একটি জায়গা। সম্পর্ক মানে একটি পরশ।
লেখক: সাইকোথেরাপিস্ট কনসালট্যান্ট, ঢাকা সিটি হাসপাতাল ও সভাপতি, ঢাকা মহানগর বন্ধুসভা।