অস্থিরতা কেন হয়? অস্থিরতা কমাতে এই কাজগুলো করুন
সবকিছু আমার ভালোই চলে। কিন্তু যখন পরীক্ষা আসে, প্রেজেন্টেশন দিতে হয়, কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তখন ভীষণ অস্থির লাগে। ভেতর থেকে কেমন একটা অনুভূতি হয়। শরীরে কেমন যেন একটা কাঁপুনি অনুভব হয়। একটা ভয় কাজ করে। আমি কি আসলে পারব? আমার কি এই সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ঠিক হবে? যদি না পারি, তাহলে কী হবে? মাঝেমধ্যে বমি বমি ভাব হয়, পেটের ভেতরটাও কেমন জানি ঘুরঘুর করে!
আমরা কমবেশি অনেকেই এই চিন্তা ও অনুভূতির ভেতর দিয়ে যাই। যখন অনিশ্চয়তা বা চাপে পড়ি, তখন শরীর ও মনের মধ্যে একধরনের ‘সতর্ক সিগন্যাল’ তৈরি হয়। এটি স্বাভাবিক ব্যাপার হলেও যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে সমস্যায় রূপ নেয়। এর নাম উদ্বেগ। এটি মনের এমন এক অবস্থা, যখন আমরা নিরাপত্তাহীন, অস্থির বা নিয়ন্ত্রণ হারানোর আশঙ্কা অনুভব করি। কিছুটা উদ্বেগ স্বাভাবিক, কিন্তু অতিরিক্ত হলে তা দৈনন্দিন জীবনে বাধা সৃষ্টি করে। যেমন পরীক্ষার আগে টেনশন, চাকরির ইন্টারভিউয়ের আগের নার্ভাসনেস, প্রিয়জন অসুস্থ হলে দুশ্চিন্তা—এগুলোই উদ্বেগ।
কেন উদ্বেগ হয়
অতীত ট্রমা বা নেতিবাচক অভিজ্ঞতা, ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা, কম আত্মবিশ্বাস বা নিজেকে নিয়ে সন্দেহ, ঘুমের সমস্যা, ক্যাফেইন বা মাদকাসক্ত হলে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। এ সময় বেশ কিছু শারীরিক উপসর্গ দেখা যায়। যেমন—
• বুক ধড়ফড় করা বা হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়া।
• শ্বাসকষ্ট বা ভারী শ্বাস।
• ঘাম হওয়া।
• হাত–পা ঠান্ডা, মাথা ঘোরা বা শরীর ভারী লাগা।
• পেটের সমস্যা, বমি বমি ভাব।
• ঘুমের সমস্যা।
মানসিক যে উপসর্গগুলো দেখতে পাওয়া যায়, তা হলো—
• অতিরিক্ত চিন্তা।
• ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয়।
• মনোযোগের ঘাটতি।
• সবকিছুতে খারাপ কিছু ঘটবে মনে হওয়া।
• আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া।
• বিরক্তি, অস্থিরতা বা আতঙ্ক অনুভব হওয়া।
জীবনে কিছুটা উদ্বেগ থাকা স্বাভাবিক। এটা আমাদের সচেতন, প্রস্তুত ও দায়িত্ববান করে তোলে। কিন্তু যখন উদ্বেগ জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে, তখন সেটি আর স্বাভাবিক নয়। সেটি হয়ে ওঠে মানসিক স্বাস্থ্য সংকেত।
কখন বুঝব উদ্বেগ স্বাভাবিক মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে
নিচের লক্ষণগুলো যদি একসঙ্গে বা ঘন ঘন অনুভব হয়, তাহলে বুঝতে হবে উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে—
• চিন্তা থামানো যাচ্ছে না। বারবার একই চিন্তা মাথায় আসছে।
• যদি খারাপ কিছু হয়, এমন ভয় শরীরজুড়ে। কিছু না হলেও মনে হয় ভয়ংকর কিছু আসছে, যা দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলছে।
• পড়ালেখা, কাজ, সম্পর্ক—কিছুই মন দিয়ে করা যাচ্ছে না। ছোট ছোট সিদ্ধান্তেও আতঙ্ক।
• বাইরে যেতে, কারও সঙ্গে কথা বলতে ভয় লাগে।
• একা থাকতে ভয় হয়। আবার মানুষের মধ্যেও অস্থির লাগে। নিজেকে বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
• নিজেকে অদক্ষ ও ব্যর্থ মনে হয়। মনে হয়, অন্যরা ভালো করছে। অতিরিক্ত আত্মসমালোচনা; মনে হয়, ‘আমি ঠিকমতো কিছুই করতে পারব না’।
• উদ্বেগ দীর্ঘদিন ধরে থাকছে।
উদ্বেগ কমাতে কী করব
• নিয়মিত রিলাক্সেশন করতে হবে। যখন অস্থিরতা বাড়বে, তখন ডিপ ব্রেথ নিতে হবে।
• নিজের সঙ্গে কথা বলা। নিজেকে জিজ্ঞাসা করা, আমি যা ভাবছি, তা কি বাস্তব? আমার সঙ্গে খারাপই কিছু ঘটবে, এটার কতটা প্রমাণ রয়েছে?
• চিন্তাকে বাস্তবতার সঙ্গে তুলনা করা।
• ডায়েরি লেখা। মাথায় যে চিন্তাগুলো আসছে, সেগুলো লিখে রাখা। দিনের শেষে লিখে রাখা, সেদিন কী কী বিষয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল। শরীরের অনুভূতিগুলো খেয়াল করা এবং কোনো ধরনের জাজমেন্ট ছাড়া সেটাকে মেনে নেওয়া।
• নিজের সমালোচনা না করে নিজেকে সমর্থন করা।
• বর্তমানে থাকার চেষ্টা করা। খেয়াল করতে হবে কোথায় আছি, কী করছি?
• প্রয়োজনে পেশাদার সাইকোথেরাপিস্টের সাহায্য নেওয়া।
উদ্যোগ ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব তখনই, যখন ব্যক্তি নিজে সচেতন থাকবে। নিজের অনুভূতিগুলোর দায়িত্ব নেবে, চিন্তাগুলোর দায়িত্ব নেবে। চিন্তাগুলোর যৌক্তিক ভিত্তি খুঁজে বের করতে পারবে এবং প্রতিটি অনুভূতিকে সহানুভূতির মাধ্যমে দেখা ও অনুভব করতে হবে।
লেখক: সাইকোথেরাপিস্ট কনসালট্যান্ট, ঢাকা সিটি হাসপাতাল ও সভাপতি, ঢাকা মহানগর বন্ধুসভা।