লোকসংগীত কখনো মরে না, কখনো হারায় না

‘লিচুর বাগানে’ গান নিয়ে উন্মাদনার মধ্য দিয়ে আলোচনায় এসেছেন ছত্তার পাগলাকোলাজ
গানে যদি সত্যিকারের জীবন থাকে, মাটি ও মানুষের কথা থাকে, তবে সে গান যুগ পেরিয়েও বেঁচে থাকে মানুষের মনে।

গত ঈদুল আজহায় মুক্তি পাওয়া শাকিব খান অভিনীত ‘তাণ্ডব’ সিনেমায় একটি হৃদয়ছোঁয়া গান রয়েছে, ‘কে দিল পিরিতের বেড়া লিচুরও বাগানে...’। গানটি মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই তা নতুন করে আলোচনায় এসেছে। তবে অনেকেই জানেন না যে এই গান কোনো আধুনিক গীতিকারের রচনা নয়, বরং এটি একটি চিরায়ত লোকগীতি। গানটির রচয়িতা হলেন ছত্তার তালুকদার, যিনি ‘ছত্তার পাগলা’ নামে পরিচিত ছিলেন।

ছত্তার পাগলা ছিলেন একেবারে মাটির মানুষ; হাওরের পলিমাটি, নদীর ধারা আর কাদামাখা বাস্তবতার মধ্যেই যাঁর বসবাস। তাঁর জন্ম নেত্রকোনার পূর্বধলার হীরনপুরে। শৈশব কেটেছে লালছাপুর গ্রামে, পরবর্তীকালে তিনি বসতি গড়েন মোহনগঞ্জের নলুয়ার চরে। ছত্তার পাগলার জীবন কেটেছে কংস নদের তীরবর্তী হাওরাঞ্চলে, বিশেষ করে মোহনগঞ্জ উপজেলার বিস্তীর্ণ জলাবদ্ধ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর হাওর এলাকায়।

ছত্তার পাগলার গানগুলো মূলত রচিত হতো হাওরের নিজস্ব ভাষায়, হাওরের মানুষের অনুভূতি নিয়ে। ছত্তার পাগলা কখনো বড় কোনো মঞ্চে গান গাইতেন না। তিনি গাইতেন হাটের কোণে, মাঠের প্রান্তে কিংবা কোনো গাঁওগেরামের বৈঠকখানায়। তাঁর শ্রোতা ছিলেন গ্রামের সাধারণ মানুষ, যাঁরা জীবনের সুখ-দুঃখের গান খুঁজতেন হৃদয়ের গভীর থেকে।

পথশিল্পী হিসেবে ছত্তার পাগলা গান গাইতেন তাঁর তিন কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে। তাঁরা গেয়ে বেড়াতেন এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে, হাওরের গ্রামে গ্রামে। গানের মধ্য দিয়ে তিনি তুলে ধরতেন প্রেম, বিরহ, দারিদ্র্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পারিবারিক টানাপড়েন এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের চিত্র। তাঁর সুর ও বাণী ছিল সহজ অথচ অসাধারণ হৃদয়গ্রাহী।

ছত্তার পাগলার গানের ধরন প্রচলিত বাউল ধারা থেকে কিছুটা ভিন্ন ছিল। তিনি তৈরি করেছিলেন নিজের একটি আলাদা ধারার লোকগীতি, যেখানে সুরের সঙ্গে মিশে থাকত অনুভূতির গভীরতা, শব্দের আঞ্চলিকতা এবং জীবনের আখ্যান।

লোকসংগীতের এই প্রাণপুরুষ মৃত্যুবরণ করেন ২০১৪ সালে। তিনি রেখে গেছেন তাঁর স্ত্রী, তিন কন্যা, দুই পুত্র এবং অগণিত শ্রোতামুগ্ধ শ্রদ্ধাভাজন।

আজ যখন ছত্তার পাগলার গান আধুনিক চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হয়, তখন বোঝা যায় যে লোকসংগীত কখনো মরে না, কখনো হারায় না। বরং সময়ের বিবর্তনে, প্রজন্মের পরিবর্তনে লোকসংগীত পায় নতুন জীবন, নতুন শ্রোতা, নতুন আবেগ। ছত্তার পাগলার গানের মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হলো যে গানে যদি সত্যিকারের জীবন থাকে, মাটি ও মানুষের কথা থাকে, তবে সে গান যুগ পেরিয়েও বেঁচে থাকে মানুষের মনে।

তথ্যসূত্র: ‘নেত্রকোনার বাউল কবি: হামিদুর রহমান’ ও প্রথম আলো

সভাপতি, ময়মনসিংহ বন্ধুসভা