কত ছোট্ট একটা কবর

প্রতীকী ছবি প্রথম আলো

বৃহস্পতিবারের প্রকৃতি ছিল বিষণ্নতায় মোড়ানো। আকাশজুড়ে মেঘেদের ছোটাছুটি। আর কিছুক্ষণ পরপর তা অশ্রু হয়ে ঝরছিল। পুরো শহরে হিমশীতল দমকা হাওয়ার প্রলেপ। গাছের পাতার শব্দের তরঙ্গ কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করছিল। জানালার থাইগ্লাস ভিজে ঘোলাটে হয়ে একাকার। চোখ দুটোয় বৃষ্টিজলে পরিপূর্ণ হওয়ায় মনে হচ্ছিল চোখের দৃষ্টিশক্তি হঠাৎ বেড়ে গেল। বারান্দায় গাছগুলো স্নান করছে অঝোর জলধারায়। আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম বাইরে। ভিজে গেল পুরোপুরি।

চোখ আটকে গেল পিচঢালা রাস্তায়, লোকজন হাঁটছে, মাথায় রংবেরঙের ছাতা। কেউ যাচ্ছে অফিস-আদালতে, কেউ অন্য কোনো গন্তব্যে। কিছু শিক্ষার্থীকে দেখলাম সাদা শার্ট, খাকি প্যান্ট আর সাদা জুতা পরে দাঁড়িয়ে আছে যানবাহনের অপেক্ষায়। তারা এরই মধ্যে ভিজে গেছে। রাস্তায় রিকশা, অটোরিকশা, মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস, মোটরসাইকেল, সাইকেল, ট্রাক—সব ট্রাফিক জ্যামে আটকে আছে।

এক আত্মীয়ের মৃত্যুসংবাদ শুনে আমাকেও বাইরে বের হতে হলো। জামালপুর শহরের রাস্তায় পানি জমে আছে। যানবাহনের খোঁজে এদিক–ওদিক তাকালাম। বৃষ্টির ফোঁটায় শরীরের কিছু অংশ ভিজে গেছে। একটি সিএনজি পেয়ে গেলাম। আমার সঙ্গে আম্মু আর আপুও আছেন। আরও দুজন যাত্রী হলে তারপর সিএনজি ছাড়বে। আম্মু চালককে বলল, ‘ভাই, যান আপনি, আমি দুজনের ভাড়া দিয়ে দিব।’ বৃষ্টি হচ্ছে, বসে থাকলে আরও বৃষ্টি আসবে।

সিএনজি চলতে শুরু করল। কিন্তু একটু পথ যেতেই আবার থেমে যায়। বাদলা দিনে গাড়ির মধ্যে আটকে থাকাও বিরক্তিকর। বাতাসের ঝাটকায় বৃষ্টির ফোঁটা তেড়ে আসছে আমার মুখে। মনে হলো, অনেক পরিশ্রমের পর বেসিনের পানিতে মুখ ধুয়েও কখনো এমন প্রশান্তি লাগেনি। এই জল রহমতের, স্রষ্টা খুশি হয়েই প্রবাহিত করেছেন। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর আবার চলতে শুরু করল সিএনজি। রশিদপুর যেতেই হঠাৎ সামনের ট্রাকটি ব্রেক করলে আমাদের সিএনজিও ব্রেক করতে বাধ্য হলো; আম্মু আর আপু অপ্রস্তুত ছিল। তারা সামনের দিকে ঝুঁকে নাকে–মুখে ব্যথা পেল।

যাহোক, দীর্ঘ সময় পর গন্তব্যে পৌঁছালাম। আত্মীয় সম্পর্কে আমার ভাতিজা হয়। জন্মের তিন দিন পরেই তার মৃত্যু হলো। তাকে এটাই আমার প্রথম ও শেষ দেখা। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, আর ঘরে কাফনে মোড়ানো নিষ্পাপ শিশুর মরদেহ। তাকে দেখার প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দেখতে পারিনি। এ জন্য আফসোস থেকে যাবে। মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল।

নিষ্পাপ মুখ ওর। কতটা অভিমান করেছিল এই ছোট্ট শিশুটি, কত যে পাহাড়সম কষ্ট চেপে ধরে পৃথিবী থেকে চলে গেল। জানাজা হয়ে গেল আধো বৃষ্টিজল গায়ে মেখেই। ছোট কবরে ছোট মানুষকে দাফন করা হলো। সবাই ফিরে গেল বাড়িতে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম কবরের পাশে। কত্ত বড় এই পৃথিবীর মধ্যে কত ছোট্ট একটা কবর!

বন্ধু, জামালপুর বন্ধুসভা