ফিচার লেখার অন্দরমহল

লেখালেখিছবি: ফ্রিপিক

লেখার জাদুতে পাঠককে আবিষ্ট করে রাখার কৌশল নিয়ে গত ২৮ মে অনুষ্ঠিত হলো প্রথম আলো বন্ধুসভার ভার্চ্যুয়াল লেখালেখি কর্মশালার প্রথম পর্ব। বিকেল সাড়ে চারটায় কর্মশালা শুরু হয়। কর্মশালায় প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক সুমনা শারমীন। অনলাইন জুম প্ল্যাটফর্মে অনুষ্ঠিত এ সেশনে অংশ নেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাহিত্যপ্রেমী লেখক বন্ধুরা।

ফিচার লেখার ভেতরের খেলাঘর
প্রশিক্ষক সুমনা শারমীন বক্তব্যের শুরুতেই বলেন, ‘সারা দুনিয়া হলো ফিচারের কারখানা। যেকোনো কিছু নিয়েই ফিচার লেখা যায়; শুধু দরকার ভাষার ওপর দখল আর ভাষা নিয়ে খেলতে জানা।’ তাঁর ভাষায়, একজন ফিচার লেখকের পর্যবেক্ষণ শক্তি সাধারণ মানুষের চেয়ে ভিন্ন। অন্যরা যেটা চোখ এড়িয়ে যান, ফিচার লেখক সেটাই খুঁজে আনেন লেখনীর আলো জ্বেলে।

লেখার গভীরতা তৈরি হয় সেই বিষয়ের ওপর পর্যাপ্ত জ্ঞান, উপলব্ধি ও মানবিক সংযোগ তৈরির মাধ্যমে। যে বিষয় নিয়ে একজন লেখক লিখতে যাচ্ছেন, তা সম্পর্কে ভালোভাবে না জানলে লেখায় প্রাণ আসে না। শব্দ তখন শুধু শব্দই থাকে, জীবন্ত হয়ে ওঠে না।

ফিচারের পাঁচ স্তম্ভ
কর্মশালায় ফিচার লেখার কাঠামো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। সুমনা শারমীন ফিচার লেখার জন্য পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান তুলে ধরেন—
• শিরোনাম: প্রথমেই একটি আকর্ষণীয় শিরোনাম নির্বাচন করতে হবে। শিরোনাম পাঠককে টেনে আনে। তাই শিরোনাম এমন হওয়া উচিত, যা মূল লেখার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ; আবার এমনও হতে হবে, যাতে পাঠক কৌতূহলী হয়ে লেখার গভীরে প্রবেশ করেন। একটি ভালো শিরোনাম অনেক সময় পুরো লেখার চাবিকাঠি হয়ে ওঠে।
• ইন্ট্রো (প্রারম্ভ): ফিচারের শুরুতেই পাঠককে টেনে নেওয়ার মতো চমকপ্রদ, সংক্ষিপ্ত অথচ শক্তিশালী একটি ইন্ট্রো থাকতে হবে। লেখক এই অংশে অল্প কথায় মূল বিষয়বস্তু তুলে ধরবেন। যেন কয়েক লাইন পড়ার মাধ্যমেই লেখার প্রতি পাঠকের আগ্রহ তৈরি হয়।
• মনোযোগ ধরে রাখা: ফিচারের এই অংশে থাকতে হবে পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও প্রাসঙ্গিক তথ্য। থাকতে হবে লেখকের নিজস্ব চিন্তাধারা ও অনুভবের ছাপ। ফিচারের মূল বিষয়ের সঙ্গে মিল থাকতে হবে।

• আকর্ষণ ধরে রাখা: ফিচারের এই অংশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান ডিজিটাল যুগে পাঠকের মনোযোগ খুবই সীমিত। পাঠক শিরোনাম দেখে ক্লিক করেন, একটুখানি চোখ বুলিয়ে আবার বের হয়ে যান। তাই লেখা হতে হবে প্রাণবন্ত, ঝরঝরে ও সাবলীল। ভাষা ও উপস্থাপনায় বৈচিত্র্য আনলে পাঠক শেষ পর্যন্ত থেকে যাবেন। আর এখানেই একটি লেখার সার্থকতা। একজন লেখক যদি এই অংশে ভাষার খেলা দিয়ে লেখনীতে খেলতে পারেন, তবে পাঠক বের হতে পারবেন না। পাঠক একরকম বাধ্য হবেন পুরো লেখাটা পড়তে। এটাই আকর্ষণ। লেখার পরবর্তী অংশে কী আছে, সেটি জানার জন্য এই অংশে পাঠকের মধ্যে চাহিদা তৈরি হবে।
• সমাপ্তি: ফিচারের সমাপ্তি হতে পারে দুটি রূপে—একটি স্বাভাবিক পরিসমাপ্তি। অন্যটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই ‘শেষ হয়ে হইল না শেষ’ চরণের ভঙ্গিতে। শেষটি পাঠকের মনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে। পাঠকের তৃষ্ণা জাগরিত অবস্থায় সমাপ্তি হবে।

গল্পের খোঁজে একজন লেখক
লেখক হতে হলে শুধু কলম নয়, কান আর মনকেও প্রস্তুত রাখতে হয়। মানুষের গল্প শোনার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে একজন লেখকের হৃদয় ও ভাবনা। কর্মশালায় সুমনা শারমীন বলেন, ‘অভিজ্ঞতার চেয়ে বড় গল্প আর নেই। মানুষের জীবনে অজস্র গল্প লুকিয়ে থাকে। একজন লেখককে তাঁর লেখকসত্তা দিয়ে সেই গল্পগুলো তুলে আনতে হবে।’

লেখা মানেই লেখকচক্ষুর ভেতর দিয়ে অন্তরের গভীরে যাত্রা। একজন লেখক যখন অনেক মানুষের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গল্প শুনবেন, স্বাভাবিক বিষয়গুলোর মধ্যেও যে কত কত গল্প লুকিয়ে আছে, সেগুলো বের করে আনবেন লেখকসত্তার কৌতূহল দিয়ে, তখনই কেবল একটি ফিচার সময় অতিক্রম করে মানুষের মনে দাগ কাটবে। যুগ অতিক্রম করে চিরদিন বেঁচে থাকবে।

সুমনা শারমীন আরও বলেন, ‘একটি ভালো ফিচার শুধু তথ্য দেয় না, পাঠককে ভাবায়, আলোড়িত করে, এমনকি মাঝেমধ্যে বদলে দেয়।’ যার হাতিয়ার হলো লেখা, আর লেখক সেই পরিবর্তনের সূচনাকারী।

লেখক বন্ধুদের ডানায় লেখালেখির নতুন পালক
এই কর্মশালার মাধ্যমে বন্ধুসভার লেখক বন্ধুরা নতুনভাবে ভাবতে ও লিখতে শেখার প্রেরণা পেলেন। ফিচার যে কেবল তথ্যের সমাহার নয়; বরং গল্প, ভাবনা ও অনুভবের এক অনন্য মিশেল, তা তাঁরা উপলব্ধি করলেন।

প্রথম আলো বন্ধুসভার এ ধরনের উদ্যোগ নবীন লেখকদের জন্য সঠিকভাবে লেখালেখি শেখার এক বাস্তবতা। যেখানে শব্দেরা কেবল বাক্য গঠনের উপাদান নয়, তারা হয়ে উঠেছে অনুভবের বাহক। আগামী দিনে ফিচার লেখার জগতে এই বন্ধুরাই হয়তো হয়ে উঠবেন নতুন কারিগর, যাঁরা কথাকে রূপ দেবেন গল্পে, অনুভবে লেখনীর পৃথিবীতে।

বন্ধু, যশোর বন্ধুসভা