সেই তাঁবুর রাত, গল্পের আগুন আর মধুর বন্ধুত্বে

জাতীয় বন্ধু সমাবেশ ২০২০ছবি: লেখকের সৌজন্যে

২০২০ সালটি জীবনের এক বিশেষ স্মৃতি—প্রথম আলো বন্ধুসভার জাতীয় বন্ধু সমাবেশে অংশ নেওয়ার বছর। সময়ের পাতায় পাঁচটি বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু সেই তিন দিনের হাসি, দৌড়ঝাঁপ, নিঃসংকোচ বন্ধুত্ব আর তারাভরা রাতে গাওয়া গান—সবকিছু আজও হৃদয়ে ঠিক ততটাই উজ্জ্বল।

এ বছর আবার বন্ধু সমাবেশের খবর শুনে বুকের ভেতর অদ্ভুত আলোড়ন। মনে হচ্ছে আবার যেন সেই সময়টাতে ফিরে যেতে পারব—অপরিচিত মুখগুলোর সঙ্গে প্রথম দেখায় বন্ধুত্ব হয়ে যাওয়ার সেই অলৌকিক মুহূর্তে।

গোপালগঞ্জ থেকে যাত্রা
গোপালগঞ্জ থেকে আমরা কয়েকজন চেনা মুখ, এক বাসে উঠেছিলাম। উদ্দেশ্য, ঢাকা হয়ে গাজীপুরের মৌচাক স্কাউট প্রশিক্ষণকেন্দ্র। ব্যাগের ভেতরে কাপড়চোপড় আর মনভরা উত্তেজনা। হাতে আমাদের যত্ন করে বানানো দেয়ালিকা। মনে আশা, এইবার আমরা সেরা হব।

সন্ধ্যার আলোছায়ায় যখন স্কাউট মাঠে পৌঁছালাম, মনে হলো যেন একটা কিশোর উপন্যাসের পাতা খুলে ঢুকে পড়েছি। সারি সারি তাঁবু, তার সামনে ব্যানার, রঙিন কাগজ, বেলুনের সাজ আর শত শত নতুন মুখ—সবাই এক সুরে বাঁধা, বন্ধুসভার বন্ধুত্বে।

দেয়ালিকার কথা মনে পড়তেই হাসি পায়! ভেবেছিলাম পুরস্কার নিশ্চিত। কিন্তু দেখি দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা বন্ধুরা কী অসাধারণ সৃজনশীলতা দেখিয়েছে! টপ টেন তো দূরের কথা, টপ টোয়েন্টিতেও ছিলাম না! তবু শেখাটা ছিল মূল্যবান। বন্ধুদের চেষ্টা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম, প্রতিযোগিতা ভুলে একসঙ্গে আনন্দ করেছিলাম।

তাঁবুর রাত
প্রথমবার তাঁবুতে থাকা, অদ্ভুত এক উত্তেজনা। রাতের আকাশে তারা, চারদিকে ঝিরঝিরে হাওয়া আর আমাদের হাসি-আড্ডা। কেউ গান ধরে, কেউ কবিতা, কেউ হঠাৎ শুরু করে গল্প—আর সবার মাটির গন্ধে মেশা সেই রাতের দিকে ছুটে যাওয়া।

প্রথম দিনই বুঝে গিয়েছিলাম—বন্ধুত্ব জন্মাতে দীর্ঘ সময় লাগে না, শুধু লাগে একটা আন্তরিক মুহূর্ত। আর সেই মুহূর্তগুলোই সমাবেশে প্রতি মুহূর্তে জন্মাচ্ছিল।

আবার সমাবেশের খবর শুনে সেই অনুভূতি যেন নতুন করে জেগে উঠেছে
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

তারকাদের উপস্থিতি
উদ্বোধনী দিনের পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত, সাহিত্যিক আনিসুল হক স্যারের উপস্থিতি—সবকিছু যেন গর্বের অনুভূতি ছড়িয়ে দিয়েছিল বুকে।

রওশন ভাই ও প্রিন্স ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো, কথা হলো। রওশন ভাইয়ের স্ত্রী ফারহানা মোবিন ম্যাম অটোগ্রাফসহ বই উপহার দিয়েছিলেন।

আর জয়া আহসানের সঙ্গে সেই ক্ষণিকের দেখা! মনে হয়েছিল পর্দার তারকা নন—একদম প্রাণের মানুষ। বন্ধুসভার প্রতি তাঁর ভালোবাসা শুনে গর্বে বুক ভরে গিয়েছিল।

বিকেলে গান, নাচ, গ্রুপ পারফরম্যান্স, রাতের মজার গেম—মোরগ লড়াইয়ে প্রথম হওয়া আর বন্ধুদের আমাকে কাঁধে তুলে উল্লাস করা—এসব মুহূর্ত আজও হৃদয়ের ভল্টে জমা।

বন্ধুত্ব
সারা দেশ থেকে আসা বন্ধুসভার বন্ধুদের সঙ্গে মাত্র তিন দিনেই আমরা যেন একে অপরের গল্পে ঢুকে পড়েছিলাম। কোথা থেকে এসেছে, কিসে পড়ে, তাতে কোনো গুরুত্ব ছিল না—মুখগুলো দেখলেই মনে হতো, এরা আমার মানুষ।

সুন্দরবন এলাকার এক বন্ধু খাঁটি মধু নিয়ে এসেছিল। সেই সন্ধ্যায় মধু খেতে খেতে হাসির ঝিলিক, তাঁবুর পাশে অস্থায়ী টয়লেটের অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, স্কাউট মাঠের বিশালতায় হারিয়ে যাওয়া, বড় প্লেনের সামনে ছবি তোলা—সব মিলিয়ে সেই দিনগুলো ছিল বাস্তব আর স্বপ্নের ঠিক মাঝামাঝি।

আবার ফিরে যাওয়ার অপেক্ষা
শেষ দিন চলে আসার সময় বুকটায় টান ধরেছিল। মনে হয়েছিল, কেউ যেন কান ধরে বলে দিক—‘আরও এক দিন থাকো’। তবু আমরা ফিরেছিলাম—ব্যাগভরা স্মৃতি আর চোখভরা নতুন স্বপ্ন নিয়ে। আর আজ, আবার সমাবেশের খবর শুনে সেই অনুভূতি যেন নতুন করে জেগে উঠেছে।

বন্ধুদের সঙ্গে আবার দেখা হবে, নতুন বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় হবে, দেয়ালিকা বানাব, গান গাইব, তাঁবুতে ঘুমাব আর জীবনের আরেকটা উজ্জ্বল অধ্যায় লেখার প্রস্তুতি নেব। আর অপেক্ষা সহ্য হচ্ছে না। ডিসেম্বর আসুক দ্রুত!

বন্ধুসভার এই বন্ধনটাই তো জীবনের আসল প্রাপ্তি—বন্ধুতে বন্ধুতে গড়া এক ভালোবাসা, যেটা সময়কে হারিয়ে দেয়।

যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, গোপালগঞ্জ বন্ধুসভা