সেই ছোট্ট আমিকে খুঁজি
রাত গড়িয়ে ভোর হতে চলেছে। জানালার বাইরে ধূসর আবছা আলো। শহর এখনো ঠিক জেগে ওঠেনি। অথচ আমার ঘুম ভেঙে গেছে বহু আগেই—এক অদৃশ্য ক্লান্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে চেয়ে থাকি সিলিংয়ের দিকে। মনে হয়, জীবন যেন একটা দীর্ঘ, নিঃশব্দ সিঁড়ি। যে সিঁড়ির প্রতিটি ধাপ অতিক্রম করা মানেই হলো কিছু হারিয়ে ফেলা।
আজকাল পেছনে ফিরে তাকাতে ইচ্ছা করে। ঠিক শৈশবের মোড়ে, সেই রোদজ্বলা উঠানে, যেখানে তপ্ত দুপুরগুলো ছিল অনন্ত, বিকেলগুলো ছিল খেলায় মুখর আর সন্ধ্যা মানেই মায়ের কণ্ঠস্বর—‘বাড়ি চলে আয়, বাতাস ঠান্ডা হচ্ছে।’ সে সময়টায় আমি জানতাম না দায়িত্ব কী, কিংবা সময়ের মূল্য বলতে কিছু আছে। কেবল জানতাম, আকাশে পাখি ওড়ে আর মাঠে দৌড়ে বেড়ালে হৃদয়টা হালকা হয়ে যায়।
আজ, ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দিন কাটে। মানুষের মুখে হাসি দেখি; কিন্তু চোখে দেখি যান্ত্রিক ক্লান্তি। নিজেকেও দেখি এক ভদ্র মুখোশ পরে থাকা মানুষ হিসেবে। যে হাসে, মাথা নাড়ে, দায়িত্ব পালন করে। অথচ হৃদয়ের গহিনে বয়ে চলে এক নীরব ক্ষয়।
বুকের ভেতর কোথাও একটা ছোট্ট আমি এখনো রয়ে গেছে। সে এখনো বিকেলের আলোয় হারিয়ে যেতে চায়, কাঁদতে চায় বিনা কারণে, খালি পায়ে দৌড়ে বেড়াতে চায় কাঁচা রাস্তার ওপর দিয়ে। অথচ আমি তাকে চেপে রাখি, প্রাপ্তবয়স্কের শিষ্টাচারে, সংসারের অভ্যাসে এবং সমাজে টিকে থাকার বুদ্ধিতে। আসলে বড় হওয়া মানে কি কেবল দায়িত্ব নেওয়া, নাকি নিজেকে প্রতিদিন একটু একটু করে ভুলে যাওয়া?
রঙিন দিনগুলো এখনো চোখে ভেসে ওঠে—মাটির সোঁদা গন্ধ, আমের ডালে দোল খাওয়া ছায়া অথবা বৃষ্টির দিনে মায়ের আঁচলের নিচে গুটিসুটি হয়ে থাকা আমি। তখনকার সুখগুলো ছিল ব্যাখ্যাতীত। তারা ছিল নিঃশর্ত, নিঃশব্দ; অথচ গভীর। আজ সেই দিনগুলো নেই। আজ কেবল হিসাব, হাহাকার, আর ‘ভালো আছি’ বলা অভিনয়। তবু প্রতিদিনের শেষে চুপি চুপি সেই ছোট্ট আমিকে খুঁজি। সেই আমি, যে জানত কীভাবে বাঁচতে হয়।
চান্দগাঁও, চট্টগ্রাম