মায়ের বাগানের ঝরা বকুল
মা বলতেন, ‘তুই বড় হবি, সঙ্গে সঙ্গে আমার লাগানো গাছটিও বড় হবে। গাছে ডাব ধরবে, নারকেল হবে। সেই নারকেল প্রতিবেশী, পশুপাখি খাবে। সৃষ্টিকর্তা একটা গাছের মধ্যে কত মানুষের রিজিক বরাদ্দ রেখেছেন।’
মাকে দেখতাম বাড়ির উঠানের চারপাশে নানা জাতের গাছগাছালি ও সবজি চাষ করতেন। গাছে পানি দিতেন, লালু জেঠাকে দিয়ে শুকনা গোবর দিতেন। ছোটবেলা থেকে দেখেছি প্রকৃতির প্রতি মায়ের ভালোবাসা। উঠানের প্রতিটি বৃক্ষ যেন তাঁর এক একটা সন্তান। একসময় কলেজে ভর্তি হলাম। গাছগুলো দেবদারুগাছের মতো আকাশ ছুঁতে লাগল। গাছে থোকা থোকা আম, ডাব ঝুলছে। মা বলতেন, ‘গাছ থেকে শেখার অনেক কিছু আছে।’ গাছগুলো যত আকাশ ছুঁতে লাগল, দেখলে মনে হতো নিচের দিকে কিছুটা মাথা ঝুঁকে আছে। মা বলতেন, ‘যত বড় হবি, বৃক্ষের মতো বিনয়ী হবি। নিচের দিকে ঝুঁকে থাকবি। ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করবি। কখনো অহমিকা করবি না। সব সময় মানুষের উপকার করবি। মানুষের প্রতি ভালোবাসার হাত প্রসারিত করে রাখবি।’
তখন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে অনার্সে পড়ি। একদিন বাড়ি গিয়ে দেখি মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। কী হয়েছে জানতে চাইলে জানালেন, বাগানের সবচেয়ে শখের কালো জামগাছটা প্রতিবেশীরা কেটে ফেলেছে। গাছে জামও ধরেছিল। সে জাম বাড়ির লোকজন খেত। গাছের ডালপালা এবং কিছু অংশ প্রতিবেশীর জায়গায় পড়েছে, ওরা দেয়াল দেবে। অনেক আকুতি মিনতি করেছিল গাছটি না কাটার জন্য। মায়ের কথা ওরা কর্ণপাত করেনি। মায়ের চোখের সামনে তাঁর সন্তানতুল্য প্রিয় গাছের বুকে কুড়াল-দায়ের কোপ পড়ল। মাকে বলেছি, ধৈর্য ধরেন, আপনাকে আরও উন্নত জাতের গাছ এনে দেব।
পড়ালেখা শেষে টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানিতে গ্রাহকসেবা কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিলাম। প্রথম মাসের বেতন পেয়ে মায়ের জন্য জাম, জামরুলসহ নানা জাতের গাছ কিনে আনি। মায়ের চোখে খুশির অশ্রু দেখেছিলাম সেদিন। ওনাকে সঙ্গে নিয়ে গাছগুলো রোপণ করলাম। দুই বছরের মধ্যে গাছে ফল দিল। মা গাছের ফল পাড়লে, যারা গাছ কেটেছে, তাদেরকেও দিতেন।
সেই চাকরি ছেড়ে পরে একটি বেসরকারি ব্যাংকে যোগ দিলাম। পোস্টিং ঢাকায়। যান্ত্রিক নগর থেকে যেদিন বাড়ি যাই, বাড়ি না পৌঁছা পর্যন্ত মা অস্থির থাকতেন। বাড়ি পৌঁছামাত্র ওনার ব্যস্ততা শুরু হয়ে যেত। বিছানা ঘুছিয়ে দেবে, মশারি টাঙিয়ে দেবে, মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে। নিজ হাতে খাইয়ে দেবে। ঘুমিয়ে পড়লে চাদর দিয়ে শরীর ডেকে দেবে। মায়ের আদরের শেষ নেই।
সকালে মায়ের মধুর কণ্ঠে কোরআন তেলাওয়াত শুনে ঘুম ভাঙত। বলতেন, ‘কিরে এখনো ঘুমিয়ে? খিদা লাগেনি বুঝি। উঠ বাবা, নামাজ পড়ে নাশতার টেবিলে আয়। বেলা গড়িয়েছে।’
দরজা খুলে দেখি মা দাঁড়িয়ে। ওনার স্নেহভরা মুখটা দেখে খিদে চলে যায়। সকালবেলা ওনার মুখ দেখার মধ্যে একটা সুখ আছে, তৃপ্তি আছে। মা কত রকমের ভোজনরসদ তৈরি করতেন। নাশতার টেবিলে ডাবের পানি, চিতই পিঠা, পুলি পিঠা, পায়েস, কত কী! তিনি পাশে বসে থাকতেন, নিজে খেতেন না। জিজ্ঞেস করতাম, তুমি খাবে না? বলতেন, ‘তুই খেলে আমার খাওয়া হয়ে যাবে।’
‘কত বললাম, বদলি হয়ে চট্টগ্রামে চলে আয়।’ জবাবে বলতাম, ‘মা, ক্যারিয়ারের জন্য ঢাকায় থাকা। চাকরির পাশাপাশি আমার আরেকটি জগৎ আছে, অবসরে লেখালেখি করা।’
বছর তিনেক আগে মা দিবসে বন্ধুসভার পাতায় ‘মা তোমাকে ভালোবাসি’ শিরোনামে লেখা প্রকাশিত হলো। মা আমার লেখাটি পড়ে আনন্দে অশ্রু বিসর্জন দিলেন। দুহাত তুলে দোয়া করলেন।
দুই বছর আগে মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আগের মতো হাঁটতে পারেন না, হুইলচেয়ারে বসে থাকেন। মাঝেমধ্যে হুইলচেয়ার নিয়ে বাগানে চলে আসেন। নিজের লাগানো গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকেন। প্রকৃতিকে নাকি রূপ-রস–গন্ধ দিয়ে উপভোগ করতে হয়। তিনি গাছের পাতায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিতেন। এলাচি লেবুর পাতা হাতে নিয়ে শুঁকে দেখেন। জামরুলগাছের দিকে তাকিয়ে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দেন। একদিন মুঠোফোনে বাবা বললেন, ‘তোর মায়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে।’
বাড়ি ফিরে দেখি মা বিছানায় শুয়ে আছেন, বাক্রুদ্ধ। আমাকে দেখে দুই নয়ন জলে ভাসালেন। কথা বলতে পারছেন না, ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছেন। মায়ের এ অবস্থা দেখে নিজেকে স্থির রাখতে পারিনি। ওই দিন ছিল বুধবার, রাতেই আবার ঢাকায় ফিরে আসি। পরদিন অফিসের ডেস্কে বসে বারবার চোখ মুছছিলাম। মন পড়ে আছে মায়ের কাছে। বৃহস্পতিবার অফিস শেষ করেই সুবর্ণ এক্সপ্রেসে চট্টগ্রাম। যাত্রাপথে মায়ের মলিন মুখখানি মনমন্দিরে নীল পদ্মের মতো ভেসে উঠছিল, আর আমি কান্না করছিলাম। আমার কান্নার শব্দ কেউ শুনতে পায়নি।
২০২৪ সালের ৮ জুন, শুক্রবার। সবাই রাতের খাওয়া শেষে মায়ের পাশে বসে রইলাম। ঘড়ির কাঁটার শব্দ রাতের নীরবতাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে চলেছে। তিন কাঁটা বারোটার ঘরে মিলিত হতে চলেছে। টানা দুই দিন জার্নি করার কারণে খুব ক্লান্ত লাগছিল। মায়ের বাগানবাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে দেখলাম হঠাৎ জোনাকির দল ছোটাছুটি করছে। হুতোম প্যাঁচা ডাকছে। আর্তনাদ করে ডাকছে নিশাচর পাখি। ভয়ে গা ছম ছম করে উঠল। ছোট বোন চিৎকার দিয়ে বলল, ‘ভাইয়া, মা কেমন করছে।’ সে মাকে জড়িয়ে বুকে নিল। আমি গিয়ে মায়ের হাতে হাত রাখলাম। ওনার শরীর হিম ঠান্ডা, চোখ বন্ধ। আল্লাহ বলে কেবল একবার ডাক দেন। এরপর নিস্তেজ। ডাক্তার বন্ধু হুমায়ুনকে ফোন দিলাম। সে বলল, ‘খালামণি আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়েছেন।’ শুনে যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। চিৎকার দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম হাসপাতালের উদ্দেশে। ডাক্তার আশরাফকে সঙ্গে নিয়ে এলাম।
ঘরে প্রবেশ করে দেখি আগর বাতির শুভ্র ধোঁয়া, মাকে শেষ গোসল দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। বাবা, ছোট বোন সবাই চিৎকার করে কাঁদছে। ডাক্তার আমার কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিলেন। গভীর রাতে কান্নার শব্দে সবাই ছুটে এলেন। মাকে যখন শেষ গোসল করানো হচ্ছিল, আকাশ ঝাঁকিয়ে বৃষ্টি নামল, শির শির বাতাস, মসজিদ থেকে ফজরের আজান ভেসে আসে।
এখন সবই আছে, শুধু মা নেই। তিনি ছিলেন আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। মায়ের বাগানের বৃক্ষের ছায়ায় গেলে এখনো ওনার স্পর্শ খুঁজে পাই। সেদিন দেয়ালে টাঙানো মায়ের ছবির সামনে গিয়ে যখন আনমনে দাঁড়িয়ে ছিলাম, মনে হচ্ছিল তিনি যেন আমার মাথায় হাত রেখে বলছেন, ‘এই কথাটি মনে রেখো, তোমাদের এই হাসিখেলায় আমি যে গান গেয়েছিলাম, জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়। শুকনো ঘাসে শূন্য বনে আপনমনে অনাদরে অবহেলায়।’
উপদেষ্টা, পটিয়া বন্ধুসভা