স্মৃতির চিলেকোঠায় ঈদ

ছবি: এআই/বন্ধুসভা

সময়ের স্রোতে মানুষ বদলায়, বদলায় চারপাশ। এর মধ্যেও কিছু স্মৃতি থাকে চিরনতুন, হৃদয়ের গহিনে সংরক্ষিত এক রঙিন পাণ্ডুলিপির মতো। ঠিক যেমন শৈশবের ঈদ—একটি শব্দ নয়, এক অনির্বচনীয় অনুভূতির নাম। এখনকার ঈদে হয়তো প্রযুক্তির ছোঁয়া আছে, জাঁকজমক আছে, কিন্তু নেই সেই সাদাসিধে আনন্দ, সেই চেনা গন্ধ, সেই অপার অপেক্ষা। শৈশবের ঈদ ছিল নিখাদ, নির্মল—হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া এক স্বর্ণালি অধ্যায়।

ঈদের আগের সন্ধ্যাটা ছিল এক অদ্ভুত উন্মাদনায় ভরা। ছোট্ট আমি আর ভাইবোনেরা ছুটে যেতাম উঠানে কিংবা ছাদে, কেবল একটি খবরের জন্য—‘চাঁদ উঠেছে?’ কেউ বলত, পশ্চিমের আকাশে দেখা গেছে পাতলা রুপালি ফালি, কেউ আবার ঘোরতর যুক্তি নিয়ে বলত, ‘ওটা স্রেফ মেঘের টুকরা!’ যখন নিশ্চিত চাঁদ দেখা যেত, পাড়া যেন জেগে উঠত নতুন প্রাণে। মাইকে তাকবিরের ধ্বনি, মায়ের হাতে লুচি-সেমাই বানানোর ব্যস্ততা, আর আমাদের চোখেমুখে ঈদের উচ্ছ্বাস—এসব মিলিয়ে সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা।

ঈদের আগে বাবার সঙ্গে দোকানে গিয়ে জামা বাছাই করা, সেলাইয়ের ফাঁকে ফাঁকে দোকানে গিয়ে একঝলক দেখে ফেলা—এই আনন্দের কোনো তুলনা হয় না। জামা পেয়ে যাওয়া মানেই তা প্রতিদিন একটু একটু করে পরা, আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখার অদ্ভুত আনন্দ। ঈদের দিন ভোরবেলা সেই জামার নতুন গন্ধ যেন মনে হতো এক অন্য রকম পৃথিবীর দরজা খুলে দিয়েছে।

ঈদের দিন সকালে ঘুম ভাঙত এক অপার্থিব শব্দে—‘আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর...।’ মসজিদ থেকে ভেসে আসা সেই তাকবির আজও কানে বাজে। মায়ের ঘরে তখন সেমাইয়ে লেগে থাকা এলাচি-দুধের মিষ্টি গন্ধ, রান্নাঘরে কাবাবের ধোঁয়া, আর ছোটদের কণ্ঠে ঈদের গানের সুর—এসব সকাল আজও মনকে অদ্ভুত নরম করে তোলে। ঈদের নামাজ শেষে সবাইকে সালাম করা, দাদু-চাচাদের কাছ থেকে ঈদি নেওয়া, এই ছোট ছোট আনন্দ ছিল তখনকার বড় প্রাপ্তি।

সন্ধ্যার আগেই শুরু হতো পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি। কার জামা কত রঙিন, কার জুতার শব্দ বেশি, কে কয়টা ঈদি পেয়েছে—এসব নিয়ে চলত প্রতিযোগিতা। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি দৌড়ে গিয়ে সেমাই খাওয়া, পটকা ফোটানো আর হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে গল্প—এই আনন্দে ছিল নির্মল বন্ধন আর একান্ত শৈশব।

গ্রামে ঈদ মানেই ঈদমেলা। হাটের পাশের খোলা মাঠে বসত রঙিন দোকানপাট-নাগরদোলা, বায়স্কোপ, বাঁশি, পুতুল, কাঠের তলোয়ার, কাচের চুড়ি। দুই-তিন টাকা হাতে নিয়ে সেই মেলায় যাওয়ার আগে ছিল এক বিশাল প্রস্তুতি। মেলা থেকে কেনা ছোট্ট একটি খেলনাও তখন ছিল সবচেয়ে বড় সম্পদ। পথে পড়ে গিয়ে সেটা ভেঙে গেলে চোখ ভিজে উঠত। আজ মনে হলে সেই কান্নাও যেন কত মধুর লাগে।

রূঢ় বাস্তবতা হলো আজকালকার ঈদে শৈশব নেই। এখন ঈদের সকালে মুঠোফোনের স্ক্রিনে শুভেচ্ছা আসে, কিন্তু নেই সেই মানুষগুলোর স্পর্শ। নেই দাদুর পকেট থেকে লুকিয়ে বের হওয়া ঈদি, নেই পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে মেলায় যাওয়া, নেই মায়ের হাতের গরম জিলাপি। জামা হয়তো দামি হয়, খাবার হয়তো রকমারি, কিন্তু সেই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আর নির্মল আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায় না।

শৈশবের ঈদের স্মৃতি মানে এক পবিত্র আনন্দভূমি, যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত ছিল সত্যিকার উৎসব। এখন ঈদে হয়তো আছে আরাম, আছে সুযোগ-সুবিধা, তবে শৈশবের ঈদের সেই গন্ধ, রং, উচ্ছ্বাস কোথাও নেই। সেই দিনগুলো ফিরবে না, তবে স্মৃতির চিলেকোঠায় তারা আজও জীবন্ত, স্পন্দিত।

দুর্যোগ ও ত্রাণ সম্পাদক, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি বন্ধুসভা