উত্তর ইউরোপের অন্যতম ঐতিহাসিক ও সবুজ শহর স্টকহোম। ১৪টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত এ শহরকে উত্তরের ভেনিস বলা হয়। এটি রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও রাজপরিবারের কেন্দ্রবিন্দু। তারই এক অনন্য নিদর্শন স্টকহোম সিটি হল। সুইডিশ স্থপতি রাগনার উস্টবার্গ কুংসহোলমেন দ্বীপের মালারেন হ্রদের তীরে নির্মাণ করেন Stockholm Stadshus (স্টকহোম সিটি হল)। ১৯১১ থেকে ১৯২৩ সাল, প্রায় ১২ বছর ধরে চলে এর নির্মাণকাজ। ১৯২৩ সালের ২৩ জুন স্টকহোম শহরের ৭০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সুইডেনের তৎকালীন রাজা গুস্তাভ ভি স্টকহোম সিটি হল উদ্বোধন করেন।
মানব ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। গত ৩০ অক্টোবর জরুরি কাজে স্টকহোমে বাংলাদেশ দূতাবাসে যাই। কাজ শেষ করে বাসে আর মেট্রোযোগে যাই স্টকহোম সেন্টারে। নতুন শহর, তাই অনেক কিছু জানার ইচ্ছা জাগে। আশপাশটা ঘুরে দেখতে শুরু করি। এত মানুষের আনাগোনা দেখে মনে একটু শান্তি লাগল। নিজের ভুলের কারণে ফোনে ইন্টারনেট সংযোগও ছিল না। কোথায় যাচ্ছি জানতাম না, সাইনবোর্ড দেখে হাঁটতে থাকি। অন্য রকম এক অনুভূতি কাজ করছিল, তবে হারিয়ে যাওয়ার কোনো ভয় কাজ করছিল না। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সোনালি মুকুটের একটি টাওয়ার চোখে পড়ল, ছবি তুলে নিলাম। কাছে গিয়ে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল, সিলেটের বৃষ্টির মতো!
পৌঁছালাম স্টকহোম সিটি হলের সামনে। নিজেকে ভাগ্যবান মনে হলো, রাস্তা না চিনে এতটা সঠিক জায়গায়ও আসা যায়। ভেতরে ঢুকে দেখি টিকিট কাউন্টার আছে। মনে একটু আসার আলো জাগল। কাউন্টারে ঢুকে টিকিট কিনতে চাইলে ওরা বলল, ‘আমাদের গাইড ট্যুর আর মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে শুরু হবে, তুমি খুব ভাগ্যবান।’ খানিক হেসে টিকিট নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। একটু অপেক্ষা করার পর ট্যুর গাইড এলেন। সবাইকে নিয়মকানুন সম্পর্কে জানালেন।
প্রথমে প্রবেশ করলাম ব্লু হলে (Blue Hall), যেখানে প্রতিবছর নোবেল পুরস্কার বিতরণের পরে আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য নৈশভোজের আয়োজন করা হয়। হলের এক পাশে, শুরুতেই চোখে পড়ল একটি বিশাল পাইপ অর্গান; এখানে এটিকে বিশেষ একটি নামে ডাকা হয়—দ্য ব্লু হল অর্গান। এতে আছে ১০ হাজার পাইপ এবং ম্যানুয়াল কি ও প্যাডেল। নোবেল পুরস্কারের নৈশভোজের সংগীতানুষ্ঠানের সময় এটি বাজানো হয় এবং অন্যান্য বড় অনুষ্ঠানেও ব্যবহার করা হয়। এই পাইপ অর্গানকে স্টকহোম শহরের সংগীত ঐতিহ্যের গর্ব হিসেবে ধরা হয়।
ব্লু হলে থাকা প্রতিটি স্থাপনার আলাদা ইতিহাস আছে। পাইপ অর্গানের ঠিক ডান পাশেই আছে গ্রানাইট ও মার্বেল পাথরের তৈরি একটি সিঁড়ি। সিঁড়িটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যেন কেউ নেমে আসার সময় রাজকীয় ভঙ্গি ও দেখার ভারসাম্য থাকে। সিঁড়িটি তৈরির সময় স্থপতি একটি মডেল তৈরি করে রিহার্সালও করিয়েছিলেন। যেন নিশ্চিত হওয়া যায় রাজপরিবারের সদস্যরা হাঁটার সময় তাঁদের ভারসাম্য ঠিক থাকে। আজকের দিনে নোবেল বিজয়ীরা রাজপরিবারের সঙ্গে এই সিঁড়ি দিয়ে ব্লু হলে প্রবেশ করেন। সিঁড়িটি ব্লু হলকে সিটি হলের দ্বিতীয় তলায় থাকা গোল্ডেন হলের সঙ্গে যুক্ত করেছে। হলটিতে থাকা জানালা ও পিলারগুলো দেখলে স্থপতি উস্টবার্গের সৃজনশীল ও শৈল্পিক চিন্তাভাবনা কিছুটা আন্দাজ করা যায়। ইতালীয় রেনেসাঁস ও সুইডিশ শৈলীর মিশ্রণে তৈরি করা হয় জানালার ফ্রেমগুলো। বড় আর্চ আকৃতির জানালাগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যেন দিনের বিভিন্ন সময়ের রোদের আলো হলের লাল ইটের দেয়ালে ছায়া–রূপ সৃষ্টি করতে পারে। গ্রানাইট পাথরে খোদাই করা নরডিক শৈলী পিলারগুলোকে এক অনন্য রূপ দিয়েছে; যাকে শক্তি ও ঐক্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
আরেকটি মজার ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো ব্লু হলের রং কিন্তু নীল নয়! কেন? ১৯১০ সালে যখন স্থপতি উস্টবার্গ এটির নকশা করেন তখন ভেবেছিলেন হলের দেয়ালের রং দেওয়া হবে নীল; যাতে আকাশের প্রতিফলন বোঝা যায়। ১৯২৩ সালে যখন নির্মাণকাজ প্রায় শেষ তখন সেই লাল ইটের মধ্যে রোদের আলো–ছায়া দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে যান। তখনই সিদ্ধান্ত নেন, এই দেয়াল রং করা হবে না। আর যদি করা হয়, তবে অন্যায় হবে। কিন্তু তত দিনে এই হলের নাম ব্লু হল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এ নিয়ে ওই সময়ে ব্যাপক সমালোচনা হলেও তিনি নাম পরিবর্তন করেননি। সবশেষে চোখে পড়ে নোবেল পদকের একটি প্রতিরূপ, যা আলফ্রেড নোবেলের স্মরণে স্থাপন করা।
এবার আমাদের যাত্রা সিটি কাউন্সিলর অফিস। এখানে শহরের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়—যেমন বাজেট, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নগর–পরিকল্পনা ইত্যাদি। সিটি কাউন্সিল সভাপতি সভা পরিচালনা করেন। সভাটি শহরের জনগণের জন্য উন্মুক্ত, যা নিয়ে সুইডিশরা গর্ববোধ করেন। কক্ষের এক পাশে আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য বসার স্থান। এই হলে মোট ১০১ জন কাউন্সিলর বসতে পারেন। যাঁদের বেশির ভাগই পার্টটাইম রাজনীতিবীদ, সম্ভবত ১৩ জন কাউন্সিলর ফুলটাইম রাজনীতিতে যুক্ত আছেন। এই হলের কাঠের বিমগুলোতে নরডিক মোটিফ ও প্রতীকী আঁকা আছে, যা প্রকৃতির প্রতীক। আর ছাদ তৈরি করা হয়েছে উল্টো ভাইকিংস জাহাজের আকৃতিতে। ছাদ নীল রঙে রাঙানো; মনে করা হয় এই নীল ছাদের কারণে এখানে গৃহীত সিদ্ধান্ত শহরের মানুষ শুনতে পাবে। আমার কাছে উন্মুক্ত গণতন্ত্রের এক অনন্য উদাহরণ মনে হয়েছে।
এরপর যে কক্ষে এলাম সেটা ওভাল রুম। সাদামাটা নকশা কক্ষটিকে বেশ নান্দনিক করে তুলেছে। কক্ষ থেকে মালারেন হ্রদের দৃশ্য সত্যি মনোমুগ্ধকর। ১৯২০ সাল থেকে এই কক্ষে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়ে আসছে। প্রতিবছর শত শত বিয়ের অনুষ্ঠান হয় এখানে। সিটি কাউন্সিল থেকে নিয়োজিত একজন কর্মকর্তা এই বিয়ের অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। সুইডিশরা আদিকাল থেকেই জাতি, ধর্ম, বর্ণনিরপেক্ষ বিয়েতে বিশ্বাস করে; ভালোবাসার গুরুত্বকে বেশি মর্যাদা দেওয়া হয়। সুইডিশরা মনে করে, এখানে বিয়ে মানে রাজকীয় স্বপ্নপূরণ। এ কারণে কক্ষটি স্টকহোমবাসীর কাছেও বিশেষ।
এই কক্ষ থেকে বের হতেই দেখা মেলে রাজকীয় এক করিডর, প্রিন্স গ্যালারি। সুইডিশ চিত্রশিল্পী ও রাজপরিবারের সদস্য প্রিন্স ইউগেন নেপলিয়ন নিকোলসের নামে এর নামকরণ করা হয়। করিডরের শেষ প্রান্তে তাঁর একটি আঁকা চিত্র রয়েছে। যাতে করিডরের জানালা দিয়ে দেখতে পাওয়া স্টকহোম শহরের চিত্র ফুটে উঠেছে।
করিডর থেকে বের হয়ে আমরা সিটি হলের অন্যতম ঐতিহাসিক কক্ষ গোল্ডেন হলে গেলাম। নামের সঙ্গে মিল রেখেই হলটি তৈরি করা। এতে ব্যবহার করা হয়েছে ১১ কেজি সোনা ও ১৮ মিলিয়ন মোজাইক। দেয়ালগুলোর মোজাইক ডিজাইন করেন শিল্পী আইনার ফোরসেথ। কক্ষে ঢোকার পর সোজা যে দেয়াল দেখা যায় সেখানে কুইন অব লেক মারালেনের চিত্র আঁকা, যাঁকে শহরের প্রতীকী রূপ হিসেবে ধরা হয়। চিত্রে দেখা যায় তিনি একটি সিংহাসনে বসে আছেন, এক পাশে পশ্চিম ইউরোপ ও অন্য পাশে পূর্ব এশিয়া, আর তাঁর কোলে থাকা শহরটি হলো স্টকহোম, যা কিনা দুই পাশের মধ্যে সেতুর মতো কাজ করছে। রানির মাথার ওপরে আছে ত্রিভুজাকৃতির একটি আলোকরশ্মি, যার মাঝখানে আছে লাল বৃত্ত। বৃত্তটি তিনটি ভিন্ন অর্থ বহন করে। জ্ঞান, ঐক্য, আধ্যাত্মিকতা—এই তিন ক্ষেত্রের ভারসাম্যকে বোঝাতে মূলত ত্রিভুজ ব্যবহার করা হয়েছে। লাল বৃত্তটি সূর্য, জীবন ও শক্তির প্রতীক বহন করে। হলের চারপাশের দেয়ালে আঁকা সুইডেনের রাজা ও বীরদের কাহিনি। হলটির পশ্চিমের দেয়ালে আছে চিত্রশিল্পী আইনার ফোরসেথের আঁকা এক অসাধারণ চিত্রকর্ম। যেখানে তুলে ধরা হয়েছে ইউরোপীয় সভ্যতার বিকাশ ও স্টকহোম শহরের সংস্কৃতির উত্তরাধিকারকে। হলটিতে নোবেল বিজয়ীদের নৈশভোজ শেষে আমন্ত্রিত অতিথিরা সাংস্কৃতিক আয়োজন উপভোগ করেন।
হল থেকে বের হয়ে গাইড ট্যুর আমাদের নিচে নিয়ে এসে সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে এসে যাই মারালেন হ্রদের পাশে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে স্টকহোমকে আনমনে দেখতে থাকি। কী অপরূপ সুন্দর শহর!
সাবেক সভাপতি, সিলেট বন্ধুসভা