আমার ঈদ

ছবি: এআই/বন্ধুসভা

শৈশবে কোরবানির ঈদের আগের দিন সন্ধ্যায় সবাই মিলে ছড়া কাটতাম। কেউ হাত দিয়ে বোতলে শব্দ করত, কেউ-বা কনডেন্সড মিল্কের টিনে ছিদ্র করে তাতে মোমবাতি জ্বালিয়ে মিছিল করত। তখন প্রায়ই সন্ধ্যার দিকে বিদ্যুৎ চলে যেত—লোডশেডিং যেন আমাদের আনন্দের অংশ হয়ে উঠেছিল। অন্ধকার রাস্তায় জ্বলজ্বলে মোমবাতির আলোয় ঝিকিমিকি করে উঠত আমাদের ছোট্ট মিছিলটা। মনে হতো, ঈদের আনন্দ আলো হয়ে ফুটে উঠেছে।

মিছিল করতে করতে প্রতিবেশীদের বাড়িতে গরু দেখতে যেতাম। কে কত দামে গরু কিনেছে, কার গরু সবচেয়ে বড়—এসব নিয়ে চলত আলোচনা। রাতুল আর রাশেদ গরুর দাম নিয়ে প্রায়ই বড়াই করত। তর্ক প্রায়ই গড়াত ঝগড়ায়। কেউ কেউ ওদের থামানোর চেষ্টা করত, কেউ মজা পেয়ে হাততালি দিত। দুষ্টু ছেলেগুলো কেউ গরুর দড়ি ধরে টান দিত, কেউ লেজে টান দিত, আর বাড়ির মেয়েরা ভয়ে দূরে দাঁড়িয়ে দেখত।

আজও ঈদ আসে, কিন্তু সেই ছেলেবেলার ঈদ, নির্ভেজাল আনন্দ, লোডশেডিংয়ে মোমবাতি মিছিল, ছড়া কাটা আনন্দের মিছিল আর ফিরে আসে না।

ঈদের কয়েক দিন আগে থেকেই স্কুল ছুটি হয়ে যেত। তখন আমাদের প্রধান কাজ ছিল বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে গরু দেখা আর দাম জিজ্ঞেস করা। মেঘনা নদীর তীর ঘেঁষে যে বিশাল গরুর হাট বসত, সেখান থেকে সারি সারি গরু এনে রাখা হতো পাড়ার অলিগলিতে। গরুগুলো সাজানো থাকত নানা রঙে। গলায় মালা, মাথায় রঙিন টুপি, শিংগুলো লাল রঙে মোড়ানো, ষাঁড় গরুর কুঁজে থাকত বিশেষ মালা ও ফিতা। আমরা গরুগুলোর বিশেষ বিশেষ নাম দিতাম।

এখনো মনে পড়ে বাবার সঙ্গে প্রথম হাটে যাওয়ার কথা। ২০০৩ সাল। আমি তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। বাবার সঙ্গে ভয়ে ভয়ে হাটে গেলাম, শত শত গরু দেখে বিস্ময়ে আমার মুখ হাঁ হয়ে গিয়েছিল। বাবা আমাকে শক্ত করে ধরে রেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভয় পাচ্ছিস নাহিদ?’
জবাবে আমি ‘না–সূচক’ মাথা নাড়তাম। তবে ভেতরে ভেতরে একধরনের রোমাঞ্চ আর কৌতূহল দানা বাঁধছিল—এই গরুগুলোর মধ্যে কোনটা আমাদের হবে।

বাসায় গরু নিয়ে আসার পর আমার ঘুম গায়েব হয়ে যেত। গরুকে খড় খাওয়ানো, ঘাস কেটে আনা, গরুর পিঠে হাত বুলিয়ে দেওয়া—এসব ছোট ছোট কাজ করতে করতেই অদ্ভুত এক মমতায় জড়িয়ে পড়েছিলাম তার সঙ্গে। যেন সে শুধু কোরবানির গরু নয়—আমার নিজের কেউ, আমার বন্ধু।

ঈদের আগের রাতে একরাশ উত্তেজনা নিয়ে ঘুমাতাম। কখন ভোর হবে, কখন নামাজ পড়ে কোরবানির গরুর সামনে দাঁড়াব—সে অপেক্ষায় রাত যেন শেষ হতো না। শৈশবের ঈদগুলো শীতকালে হতো। আমার বোন এসে ঘুম ভাঙিয়ে বলত, ‘ভাই, আজ ঈদ। ওঠ, তাড়াতাড়ি।’

ঈদের ভোরটাও ছিল অন্য রকম অনুভূতির। ঘুম ভাঙার আগেই মা পানি গরম করতেন। আমি কাঁপতে কাঁপতে গোসল করতাম আর মা যত্ন করে মাথায় পানি ঢেলে দিতেন। গা থেকে ধোঁয়া বের হতো, আমরা দুই ভাইবোন মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের করতাম। তারপর নতুন পাঞ্জাবি পরে ঈদের জামাতে যাওয়ার আগে গরুর গলায় হাত বুলিয়ে দিতাম। মনে হতো, ঈদের আনন্দ যেন তার সঙ্গেও ভাগাভাগি করে নিচ্ছি।

নামাজ শেষে ফিরে এসে সবাই গরুর চারপাশে জড়ো হতাম। বুকের মধ্যে কেমন যেন চাপা উত্তেজনা—ভয়, রোমাঞ্চ আর আনন্দ মিলেমিশে অজানা এক অনুভূতি হতো।

আজও ঈদ আসে, কিন্তু সেই ছেলেবেলার ঈদ, নির্ভেজাল আনন্দ, লোডশেডিংয়ে মোমবাতি মিছিল, ছড়া কাটা আনন্দের মিছিল আর ফিরে আসে না। আমার শৈশবকে খুঁজে ফিরি বর্তমানের বাচ্চাদের আনন্দে, ওদের চোখের উচ্ছ্বাসে। ওদের মধ্যে লুকিয়ে আছে ফেলে আসা শৈশব।

বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা