ভোরবেলা রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা এক কাপ চায়ের ঘ্রাণেই যেন শুরু হয় জীবনের নতুন অধ্যায়। অফিসে কাজের চাপ হোক কিংবা বিকেলের অবসরে প্রিয়জনের সঙ্গে আড্ডা, সবকিছুতেই চায়ের সঙ্গ অপরিহার্য। এক কাপ চায়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকে বাঙালির প্রাণের প্রশান্তি, স্বস্তি ও সংযোগ। কেউ বলেন, চা কেবল একটি পানীয় নয়, এটি একটি আবেগ, অভ্যাস ও সংস্কৃতি।
আজ ২১ মে আন্তর্জাতিক চা দিবস। এই দিনে বিশ্বজুড়ে চায়ের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের সম্মান জানানো হয়। সেই সঙ্গে আলোচনায় আসে চা–শিল্পের অর্থনৈতিক গুরুত্ব, টেকসই চাষপদ্ধতি ও ন্যায্য পারিশ্রমিকের বিষয়গুলো।
বাংলাদেশে চায়ের ইতিহাস প্রায় ১৮৫ বছর পুরোনো। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম চা উৎপাদনকারী দেশ। হাজারো শ্রমিকের ঘামে ভেজা প্রতিটি পাতায় লুকিয়ে আছে জীবিকার গল্প। চা শুধু আমাদের তৃষ্ণা মেটায় না, হয়ে ওঠে একেকটি পরিবারের স্বপ্ন। বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে প্রায় ১০ কোটি কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ব্যবহৃত হয়।
অফিসে কাজের চাপ হোক কিংবা বিকেলের অবসরে প্রিয়জনের সঙ্গে আড্ডা, সবকিছুতেই চায়ের সঙ্গ অপরিহার্য।
চায়ের দোকান আমাদের গ্রামীণ ও নগর জীবনের এক অদ্ভুত সামাজিক প্ল্যাটফর্ম। রাজনৈতিক আলোচনা থেকে প্রেমের গল্প, ক্রিকেটের বিশ্লেষণ থেকে সাহিত্যচর্চা—সবকিছুই ঘটে এই ছোট্ট দোকানঘরের সামনে রাখা বেঞ্চিতে বসেই। অনেক সময় চা হয়ে ওঠে প্রথম প্রেমের সাক্ষী, আবার কখনো মন খারাপের সান্ত্বনা। পাড়ার মোড়ে, গলির মাথায় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে একটি ছোট চায়ের টংদোকান যেন প্রতিদিনের আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু।
চায়ের দোকানে বসে গড়ে ওঠে নতুন বন্ধুত্ব, পুরোনো সম্পর্ক হয় আরও গভীর। কেউ একা এসে বসে নিঃশব্দে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কাটিয়ে দেয় সময়। কেউবা আসে দলবল নিয়ে আড্ডা, তর্ক ও হাসিঠাট্টা চলে চায়ের ধোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে। এখানেই বসে তরুণেরা কবিতা লেখেন, প্রেম নিবেদন করেন ও রাজনীতি নিয়ে আলোচনা জমান। চা–দোকানের বেঞ্চগুলো যেন সাক্ষী হয়ে থাকে হাজারো আবেগ ও ভালোবাসার গল্পের।
বাংলাদেশে চায়ের বৈচিত্র্যও চোখে পড়ার মতো। রং–চা, দুধ–চা, আদার চা, লেবুর চা, মালাই চা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ে জনপ্রিয়তা পাওয়া তন্দুরি চা কিংবা গ্রিন টি সবই এখন সহজলভ্য। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীর কিছু ক্যাফেতে ক্রিয়েটিভ ফিউশন চা, যেমন ম্যাঙ্গো টি, বাটার টি বা ফ্লেভারড হারবাল টির চাহিদা বাড়ছে শহুরে মধ্যবিত্তদের মধ্যে।
চা যেন আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। অতিথি এলেই জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘চা খাবেন?’ অফিসে বিরতি মানেই ‘টি ব্রেক’, সন্ধ্যায় অবসর মানেই ‘এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় বসা।’ এমনকি প্রাথমিক পরিচয়ের আলাপচারিতায়ও উঠে আসে সেই চিরচেনা বাক্য ‘চা খাবেন?’
চায়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের আত্মীয়তা, আতিথেয়তা ও আত্মার আরাম। অনেক সময় না–বলা কথাগুলোও বলা হয়ে যায় এক কাপ চায়ের পাশে বসেই।
আজকের দিনটি কেবল চায়ের প্রতি ভালোবাসা জানানোর নয়, এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত মানুষের সম্মান জানানোরও দিন। যেসব চা–শ্রমিক, পরিবেশক ও দোকানদার আমাদের প্রতিদিনের সকাল, বিকেল ও রাতকে এক কাপ চায়ের মাধ্যমে করে তোলেন আরও আপন।
চা এখন শুধু পানের বস্তু নয়, এটি হয়ে উঠেছে জীবনের প্রতিচ্ছবি। জীবনের প্রতিটি পর্বে, প্রতিটি আবেগে এক কাপ চা যেন পাশে থাকে। এক কাপ আদার চা কিংবা লেবুর চা কেবল স্বাদের নয়, অনেক সময় তা হয়ে ওঠে ভেতর থেকে জেগে ওঠার শক্তি। ছোট্ট একটি কাপের ভেতর যেন জমে থাকে এক পৃথিবী উষ্ণতা, সহমর্মিতা আর না–বলা কথার মায়া।
চায়ের প্রতি ভালোবাসা চিরন্তন। বন্ধু, পরিবার, প্রেম কিংবা নিঃসঙ্গতা সবকিছুরই এক মোক্ষম সঙ্গী চা। আজ চা দিবসে তাই শুধু এক কাপ চা নয়, মনে মনে ডেকে নিতে ইচ্ছা হয় প্রিয় কাউকে ‘চা হবে? এক কাপ চায়ে তোমাকে চাই।’
শিক্ষার্থী, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ, গাজীপুর।