জন্মদিন এল তব আজি, ভরি লয়ে সংগীতের সাজি

শৈলজারঞ্জন মজুমদার।

একবার শৈলজারঞ্জন মজুমদারের জন্মদিনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুভেচ্ছা জানিয়ে লিখেছিলেন—
‘জন্মদিন এল তব আজি, ভরি লয়ে সংগীতের সাজি
বিজ্ঞানের রসায়ন রাগ রাগিণীর রসায়নে পূর্ণ হলো তোমার জীবনে।
কর্মের ধারায় তব রসের প্রবাহ যেথা মেশে সেইখানে ভারতীর আশীর্ব্বাদ অমৃত বরষে।’

শৈলজারঞ্জন মজুমদার রসায়নবিজ্ঞানের শিক্ষক হয়েও তিনি পরিচিতি লাভ করেন সংগীতবিশেষজ্ঞ হিসেবে। তিনি রবীন্দ্রসংগীতের স্বারকলিপিকা এবং রবীন্দ্রসংগীত প্রশিক্ষক। তিনি প্রখ্যাত লেখক নীরদচন্দ্র চৌধুরীর কাছে প্রথম রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর গানের কথা শুনেছেন।

কলকাতায় অবস্থানকালে ১৯২০ সালে প্রথম রবীন্দ্রনাথের নিজ কণ্ঠে ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’ গান এবং ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে’ কবিতার আবৃত্তি শুনে রবীন্দ্র অনুরাগী হয়ে পড়েন। শৈলজারঞ্জন মজুমদারই প্রথম নেত্রকোনায় রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্‌যাপন করেন ১৯৩০ সালে।

শৈলজারঞ্জন মজুমদার ১৯০০ সালের ১৯ জুলাই নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জের বাহাম গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা রমণীকিশোর দত্ত মজুমদার ছিলেন একজন আইনজীবী। নেত্রকোনা উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯১৭ সালে ম্যাট্রিক, কলকাতার মেট্রোপলিটন কলেজ (বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ) থেকে ১৯২০ সালে আইএসসি পাস করেন। ১৯২২ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বিএসসি পাস করেন। ১৯২৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নশাস্ত্রে এমএসসি প্রথম শ্রেণিতে পাস করেন। এরপর তিনি তাঁর পিতার ইচ্ছায় আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং ১৯২৭ সালে আইন পাসও করেন।

শৈলজারঞ্জন মজুমদার ১৯৩২ সালে শান্তিনিকেতনে রসায়নশাস্ত্রের অধ্যাপকরূপে যোগ দেন। যার সুবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে রবীন্দ্রসংগীতের শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ পান। রবীন্দ্রনাথের কাছে গান শেখার পাশাপাশি তিনি রবীন্দ্রসংগীতের স্বরলিপি করা শুরু করেন।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার ১৯৭৪ সালে তাঁকে সংগীত ‘আকাদেমি’ পুরস্কারে ভূষিত করে। সংগীতে তাঁর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘দেশিকোত্তম’ এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব লিটারেচার’ উপাধি দেওয়া হয়। ২৪ মে ১৯৯২ সালে কলকাতার সল্টলেকে মৃত্যু হয় এই সংগীত অনুরাগীর।

শৈলজারঞ্জন মজুমদার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। বাহাম, মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনা
ছবি: সংগৃহীত

তাঁর মৃত্যুর দুই যুগ পর নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে জন্মভূমি বাহাম গ্রামে একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে ওঠে। বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সংসদ সদস্য সাজ্জাদুল হাসানের উদ্যোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালের ২ নভেম্বর এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সাজ্জাদুল হাসান জানান, তাঁর বাবা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও চিকিৎসক আখলাকুল হোসাইন আহমেদের সঙ্গে শৈলজারঞ্জন মজুমদারের সখ্য ছিল। এ জন্য গুণী এই ব্যক্তিকে তিনি কাছ থেকে দেখার ও জানার সুযোগ পেয়েছিলেন। শৈলজারঞ্জন মজুমদারের অবদান দেশবাসীর কাছে তুলে ধরা; দেশে রবীন্দ্রসংগীতের প্রচার, প্রশিক্ষণ ও নতুন নতুন সংগীতশিল্পী সৃষ্টিতে অবদানসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহের প্রাচীন শিল্প-সংস্কৃতিবিষয়ক বিভিন্ন গবেষণা, সংরক্ষণ ও উৎসব আয়োজন করতে এই কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি চালু হলে শিল্পী, গবেষক ও পর্যটকেরা এসে সংস্কৃতি প্রসারে কাজ করবেন।

২০২২ সালের ২৪ ডিসেম্বর প্রথম আলোয় এ নিয়ে একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
স্থানীয় সংগীত প্রশিক্ষণ রইস মনোরমের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, এই কেন্দ্র সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দিলে মানুষ রবীন্দ্রচর্চায় মনোযোগী হবে এবং শৈলজারঞ্জন মজুমদার সম্পর্কেও আরও অনেক কিছু জানতে পারবে।

সাবেক সভাপতি, ময়মনসিংহ বন্ধুসভা