ঝমঝম শব্দে জেগে থাকা মন

ছোটবেলায় ভাইবোনেরা অপেক্ষা করতাম যেদিন বৃষ্টি হবে, সেদিন আরামের ঘুম হবেছবি: এআই/বন্ধুসভা

আজ বর্ষার চতুর্থ দিন। এখন রাত ১০টা ৫৪ মিনিট। মানে বর্ষার দিন নয়, রাতে আছি। লিখতে বসছি বর্ষা নিয়ে। গত রাত থেকে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির শব্দ পাচ্ছিলাম। সকালটা শীতল, মেঘলা আবহাওয়া। সারা দিনই থেমে থেমে ভারী বর্ষণ হয়েছে। বর্ষা হাজির হলো নিজের রূপে প্রকৃতিকে সাজাতে। বর্ষার শব্দ যেন জীবনকে ছন্দময় করেছে। অসহ্য গরমে তাণ্ডব চলছিল চারপাশে, এক নিমেষেই শান্তি নামিয়ে দিল বর্ষা।

এই মুহূর্তে আকাশে তারা নেই, মেঘের আড়ালে ঢাকা, আর আমি আছি জলধারার অপেক্ষায়। মেঘে মেঘে ঘর্ষণে বর্ষণ হতে তাই আর কতক্ষণ! ভীষণ ভালো লাগার সময় বর্ষাকাল। বর্ষার মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি ফোঁটা, নদীর জোয়ার, সতেজ প্রকৃতি, নদীর মাছ প্রচণ্ড ভালো লাগার।

আমার সুন্দর একটি বাড়ির খুব শখ। তবে সেটা চার দেয়ালে বন্দী নয়, টিনের সুন্দর ছিমছাম বাড়ি।

আজ কাজ শেষে যখন বাসায় ফিরছিলাম, রিকশায় বসে মনে হচ্ছিল হুমায়ূন আহমেদের ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’ টেলিফিল্মের কথা। নুহাশপল্লিতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ শৈল্পিক ছোঁয়ার এক স্বপ্নের বাড়ি, টিনের ঘরটিতে লেখা বৃষ্টিবিলাস। হুমায়ূন স্যার শখ করে টিনের ঘরের নাম রেখেছেন বৃষ্টিবিলাস, ঘরের চালে বৃষ্টির ফোঁটার শব্দ উপভোগ করার জন্য। রিমঝিম আওয়াজ ঝমঝম করে প্রকৃতিতে সুখের তাল তুলবে।

মাঝেমধ্যে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়, আমিও টিনের ঘরে থাকি। ইশ্‌, রাতে বৃষ্টি মানেই ঝম ঝম বৃষ্টি, ঠান্ডা পরিবেশ। বৃষ্টির আওয়াজ, পাতলা কাঁথা, মাথার ওপর বৈদ্যুতিক ফ্যান, শীত শীত ভাব, হালকা কাঁপুনি, আর কী দারুণ ঘুম!

ছোটবেলায় ভাইবোনেরা অপেক্ষা করতাম যেদিন বৃষ্টি হবে, সেদিন আরামের ঘুম হবে। আর দিনের বৃষ্টি নিয়ে তো বাড়িতে কত আয়োজন। খাবারের নয়, বৃষ্টির পানি সংগ্রহের। কিছুক্ষণ বৃষ্টি হলেই ময়লা ধুয়ে পড়া শুরু করে পরিষ্কার পানি। বৃষ্টিতে সারা দিন ভিজতাম আর লাইফবয় সাবান মাখিয়ে আমরা সুরে সুরে গাইতাম ‘লাইফবয় লাইফবয় বেশি বেশি ফেনা হয়’।

মেঘের গর্জন শুনলেই বাড়ির সবাই মিলে পানি জমানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তাম। এমনও দিন ছিল, বৃষ্টির পানি কে আগে-পরে রাখবে, ঝগড়া হয়ে যেত। পানি ড্রামে ভরে অনেক দিন রাখা হতো। ভাত-ঢাল বৃষ্টির পানি দিয়ে রান্না করার জন্য। তা ছাড়া কলের পানিতে আয়রন থাকত বলে যত দিন সম্ভব ছিল জমানো বৃষ্টির পানি চুল ধোয়ার জন্য রাখতাম। কারণ, বৃষ্টির পানিতে চুল ধুলে ঝলমল করে। আরও বিশ্বাস করতাম, চুল দ্রুত লম্বা হয় এবং চুল পড়া কমে। সত্যিই এটাই হতো।

আরেকটা কথা ভেবে হাসি পায়, বর্ষাকালে বাড়ির পিচ্চিদের মাথা ন্যাড়া করা হতো এবং আমারও চুল ছাঁটাই করত। এ সময় নাকি চুল কাটলে দ্রুত বাড়ে। আমি এখনো তাই করি। যদিও এর কোনো প্রমাণ নেই; তবু কাটি চুল, যেন দ্রুত বাড়ে।

বর্ষা আমার কাছে বিশেষ ঋতু। তবে বর্ষা সব সময় সুখের ছিল না। আমাদের বাড়ি টিনের ঘর বিধায় বেশিক্ষণ বৃষ্টি হলেই চারদিকে পানি বেড়ে উঠে ধীরে ধীরে ঘরে ঢোকা শুরু করত। এমন দিন ছিল সারা দিন-রাতও বৃষ্টি হতো, যদিও এখন হয় না। আমরা খাটে বসা থাকতাম, প্রায় হাঁটুসমান পানিতে ভরে যেত ঘর। ঘরের জিনিসপত্র প্রায় অর্ধেক ডুবো ডুবো হয়ে থাকত। খানিকটা খারাপ লাগত, ঘরের ফার্নিচারগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় কাজ করত।

পরে বাড়ির সবাই মিলে যার যার ঘরের পানি বের করা শুরু করতাম উৎসব আকারে। আমাদের মধ্যে তখন প্রতিযোগিতা চলত, কার ঘরের পানি আগে বের করতে পারে। আমরাও মহা উৎসবে সর্বশক্তি দিয়ে মেতে উঠতাম এবং সফল হতাম। এত দুর্ভোগ, তারপরও কখনো চাইনি বৃষ্টি না হোক। বৃষ্টি আমাদের কাছে খুব উপভোগ্য।

আমার সুন্দর একটি বাড়ির খুব শখ। তবে সেটা চার দেয়ালে বন্দী নয়, টিনের সুন্দর ছিমছাম বাড়ি। যেমনটা হুমায়ূন আহমেদ স্যারের বৃষ্টিবিলাস ঘরটি।

বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা