সম্ভাবনার দিগন্তে একটি সমন্বিত অগ্রযাত্রা, একটি জাতির প্রকৃত উন্নয়ন কেবল মাথাপিছু আয় কিংবা অবকাঠামোগত অগ্রগতিতে সীমাবদ্ধ নয়। মানবসম্পদের সক্ষমতা, স্বাস্থ্য এবং দৃষ্টিভঙ্গিই গঠন করে উন্নয়নের সত্যিকারের ভিত্তি।
একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয় তরুণ প্রজন্মের মেধা, মনন ও মনোবলের ওপর। যুবসমাজ কেবল দেশের বৃহত্তর জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্বকারী একটি শ্রেণি নয়, বরং তারা জাতির সৃষ্টিশীলতা, উদ্ভাবনী শক্তি, সাহসিকতা ও পরিবর্তনের চালিকা শক্তি। বর্তমান বিশ্বে প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে যুবসমাজের উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের প্রশ্নটি একেবারে কেন্দ্রে চলে এসেছে। এই উন্নয়নের পথনকশায় তিনটি প্রধান স্তম্ভ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে—কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা এবং প্রযুক্তিগত সক্ষমতা।
কর্মসংস্থান
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ২০ থেকে ২৫ লাখ যুবক শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে কর্মসংস্থানের যথেষ্ট সুযোগ সৃষ্টির ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে। ফলে বেকারত্ব সমস্যাটি সামাজিক অস্থিরতার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে আমাদের কেবল চাকরির পেছনে দৌড় না দিয়ে বরং তরুণদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য একটি কার্যকর কাঠামো গড়ে তোলা জরুরি।
সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারত্বে স্টার্টআপ ইনকিউবেটর, সহজ শর্তে ব্যবসায়িক ঋণ প্রদান এবং দেশের প্রতিটি অঞ্চলে কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র সম্প্রসারণের মতো উদ্যোগ নেওয়া আবশ্যক। আধুনিক যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ডিজিটাল মার্কেটিং, সফট স্কিলস, ভাষা-দক্ষতা এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা অর্জনে প্রশিক্ষণব্যবস্থা চালু করা জরুরি। এই দিকনির্দেশনাগুলো তরুণদের আত্মনির্ভরশীল ও বিশ্ব প্রতিযোগিতায় সক্ষম করে তুলবে।
স্বাস্থ্য
উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা হচ্ছে মানবসম্পদের ভিত্তিমূল। একটি অসুস্থ প্রজন্ম কখনো শক্তিশালী জাতির ভিত্তি গড়ে তুলতে পারে না। বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর দিকে আমাদের নজর দেওয়া এখন সময়ের দাবি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপ অনুযায়ী, প্রতি চারজন তরুণের মধ্যে একজন কোনো না কোনো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে। অথচ এ বিষয়ে আমাদের সচেতনতা, পরিকাঠামো ও জনবল এখনো অপর্যাপ্ত।
প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা কেন্দ্র, নিয়মিত মেডিকেল ক্যাম্প, পুষ্টিকর খাদ্য নিয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম এবং স্বাস্থ্যবিমা সম্পর্কে শিক্ষার প্রসার এখন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্যব্যবস্থায় এই অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি শুধু যুবসমাজ নয়, সামগ্রিক উন্নয়নকেই এগিয়ে নিতে পারে।
প্রযুক্তি
আজকের বিশ্বে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বাস্তবতা আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিং, বিগ ডেটা, ব্লকচেইন ও রোবোটিকসের মতো অগ্রসর প্রযুক্তি খাতগুলো বিশ্ব অর্থনীতির গতিপথ পাল্টে দিচ্ছে। বাংলাদেশ যদি এই অগ্রযাত্রায় অংশ নিতে চায়, তাহলে আমাদের যুবসমাজকে প্রযুক্তিগতভাবে প্রস্তুত করতে হবে এখনই।
স্কুল ও কলেজ পর্যায় থেকেই কোডিং, ডিজিটাল লিটারেসি, উদ্ভাবনী চিন্তাধারা এবং সমালোচনামূলক বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার শিক্ষা চালু করা সময়োপযোগী। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানের ভাষাজ্ঞান ও আইটি দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে ‘ফ্রিল্যান্সিং ফর ডেভেলপমেন্ট’ বা ‘রিমোট জব’ খাতেও বাংলাদেশের শক্ত অবস্থান তৈরি করা সম্ভব। বিশ্বের ডিজিটাল অর্থনীতিতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে হলে আমাদের যুবকদের নির্ভরযোগ্য ও বহুমুখী দক্ষতায় গড়ে তুলতে হবে।
সম্ভাবনার দিগন্তে একটি সমন্বিত অগ্রযাত্রা, একটি জাতির প্রকৃত উন্নয়ন কেবল মাথাপিছু আয় কিংবা অবকাঠামোগত অগ্রগতিতে সীমাবদ্ধ নয়। মানবসম্পদের সক্ষমতা, স্বাস্থ্য এবং দৃষ্টিভঙ্গিই গঠন করে উন্নয়নের সত্যিকারের ভিত্তি। কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তি—এই তিনটি খাত ঘিরে সময়োপযোগী সংস্কারমূলক উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারলে বাংলাদেশ পাবে এক সৃজনশীল, আত্মবিশ্বাসী এবং উদ্ভাবনী তরুণ প্রজন্ম। যারা কেবল নিজের ভবিষ্যৎই নয়, সমগ্র জাতির গতিপথও পাল্টে দিতে পারবে। এই পথচলা সহজ নয়, তবে সম্ভব। রাষ্ট্র, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রযুক্তি খাতের সমন্বিত প্রচেষ্টাই হতে পারে এই ঐতিহাসিক পরিবর্তনের মূল চাবিকাঠি।
দুর্যোগ ও ত্রাণ সম্পাদক, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি বন্ধুসভা এবং শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ।