লেখক হওয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো চোখ-কান খোলা রেখে শেখা, চোখ-কান খোলা রেখে চলা এবং চোখ-কান খোলা রেখে বলা। মানবদেহের পাঁচটা ঢাল রয়েছে। সেই ঢাল দিয়ে কোনো তথ্য ব্রেনে গেলে আমাদের ভেতরে একটি বোধ তৈরি হয়। সেই বোধ হলো প্রত্যক্ষ করা। তখন সেখানে রূপক, বিশ্লেষণ আসবে। চোখ-কান খোলা রেখে চারপাশটাকে দেখলে আমাদের ভেতরে তথ্যগুলো সংগঠিত হবে। তারপর তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করতে হবে। ব্যক্তিবিশেষে বিশ্লেষণক্ষমতা আলাদা। বিশ্লেষণ করতে গেলে অতীত অভিজ্ঞতা লাগে।
যেমন ধরুন, আপনি বিমানে করে কোথাও যাবেন। এটা নিয়ে একটা গল্প বা উপন্যাস লিখবেন। তাহলে এখানে চরিত্র বা আপনি বিমানে যাচ্ছেন। একটু বর্ণনা দিতে হবে। এটা বাস্তব। বর্ণনার বাইরে আরও কিছু লাগবে, যেমন এয়ারহোস্টেস আপনার দিকে তাকিয়েছে; এয়ারহোস্টেসের ভঙ্গিমা, তার ভ্রু কেমন, হয়তো মনে হলো সে অন্যদের থেকেও আপনার প্রতি বেশি খেয়াল রাখছে। এভাবে কল্পনায় ঢুকে যাওয়া। যা বাস্তবতার বাইরে। এ বিশ্লেষণটা হচ্ছে নিজস্ব মেধা। এই ক্ষমতা যাঁদের বেশি তাঁরা যা দেখেছেন, এর বাইরেও আরও কিছু নির্মাণ করতে পারেন। তাঁরাই ভালো গল্পকার–লেখক হয়ে উঠতে পারেন।
গল্পের কাঠামো
ছোটগল্প বা গল্প হলো সাহিত্যের একটি অনুষদ। সাহিত্যের কোনো শর্ত নেই। তবে কিছু কাঠামো রয়েছে। সক্রেটিস বা প্লেটো যেটা ভেবেছেন, সেখানে ভাবনাতত্ত্বের কোনো স্থান নেই। যেটা দেখছেন সেটাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন, বাস্তবতাকে। তাঁরা বলেছেন, যারা কল্পনায় অনেক কিছু করে, বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, এগুলো জীবনকে বিনাশ করে।
অন্যদিকে প্লেটোর ছাত্র অ্যারিস্টটল এটা মানতে নারাজ। অ্যারিস্টটল বলেছেন, বাস্তবতা থাকবে। তবে বাস্তবতার বাইরে আরও কিছু রাখতে হবে। ভেতরে ঢুকে নতুন কিছু উন্মোচন করা। যেখানে লেখকের কল্পনা আসবে, মেধা আসবে, রূপক-উপমার ব্যবহার আসবে। দুটি অসমাপ্ত বস্তুর মধ্যে তুলনা করে একটি সার্থক রূপক-উপমা তৈরি করতে পারলে, বাস্তবতার মধ্য দিয়েও যে কেউ নিজেকে ভালো একজন সাহিত্যিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন। এটাকে বলে অনুকরণ।
গল্পের মধ্যে সমাজ থাকবে, মনস্তত্ত্ব থাকবে, দর্শন থাকবে, বিশ্লেষণধর্মী ক্ষমতা থাকবে এবং বাস্তবতা থেকে দূরে সরে যেতে হবে। তবে বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া যাবে না। এগুলো সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে।
ইতালিয়ান সাহিত্যতত্ত্ববিশারদ লনজাইনাস বলেছেন, ‘সাহিত্য হচ্ছে মনের উৎকর্ষ প্রতিধ্বনি।’ অর্থাৎ বাস্তবতা রাখতে হবে। সেই বাস্তবতা সমাজে, পরিবারে, নিজের দেখা চারপাশের ঘটনাপ্রবাহ, যা লেখকের ভেতরে মহৎ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করবে। ভাবনাচিন্তার মধ্যে স্ফুরণ ঘটাবে। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হবে। খারাপ ঘটনার মধ্য থেকেও ভালো কিছু গ্রহণ করা। এটাকে বলে মহৎ কিছু তৈরি করা।
আবার সাহিত্যে কেবল মহৎ চরিত্র সৃষ্টি হয় না, খল চরিত্রও সৃষ্টি হয়। গল্পের একটা এক্সপজিশন থাকে। অর্থাৎ শুরুটা কেমন, বিশেষ করে চরিত্রগুলোর পরিচয়, গল্প কোথায় ঘটছে এবং প্রাথমিকভাবে কী ঘটছে বা ঘটতে যাচ্ছে তার ইঙ্গিত উঠে আসে। তারপর গল্পের জটিলতা হয়, ক্লাইমেক্স হয়, দ্বন্দ্ব-সংঘাত হয়। ক্লাইমেক্স রেজল্যুশন হয়। পরবর্তী সময়ে একটা থিম, প্লট স্পষ্ট হয়। চরিত্র থাকবে, প্রেক্ষাপট থাকবে।
গল্পের একটা চরিত্র কীভাবে অন্যকে বুঝবে? কাহিনির ভেতরে দ্বন্দ্ব ইচ্ছাকৃতভাবে লাগানো যাবে না। কেবল চরিত্রের বৈশিষ্ট্যের মধ্য দিয়ে যদি সেটা আসে, তাহলে সেটাকে তৈরি করতে হবে। তখন দ্বন্দ্বটা হবে জীবনঘনিষ্ঠ। আর যদি ইচ্ছাকৃতভাবে দ্বন্দ্ব লাগান, সেটা গল্পের সৌন্দর্য নষ্ট করে দেবে। গল্পে জীবনঘনিষ্ঠ সত্যটা তুলে আনতে হবে।
একটা উপন্যাস মানে জীবনের প্রতিচিত্র, সমাজের প্রতিচিত্র। এক প্লট থেকে আরেক প্লটে যাওয়ার জন্য একটা টান তৈরি করা। এটা পাঠককে আকৃষ্ট করার একটি বৈশিষ্ট্য। উপন্যাসে অসংখ্য প্লট থাকে। তবে গল্পে দুই-তিনটি প্লট থাকে। প্লটের ভেতর দিয়ে চরিত্র ও জীবনপ্রবাহ চলতে থাকে। এই প্রবাহে চারপাশের বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে সংঘাত তৈরি হতে পারে। মোটকথা, এখানে মনের উৎকর্ষ প্রতিধ্বনি আমরা দেখতে পাই।
অনেকে কাঠামো ভেঙে নতুন কিছু নির্মাণ করতে চান। তাঁরা গতানুগতিক ধারা মানতে চান না। তাঁরা চান সব ভেঙেচুরে দিতে। এটাকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু অনেকে এটাকে সাধুবাদ জানাবেন না।
লেখক বা গল্পকার হতে চাইলে যেসব গুণ প্রয়োজন
সবার প্রথমে লাগবে মোটিভেশন। মোটিভেশন হচ্ছে উৎসাহ, আকাঙ্ক্ষা, চাহিদা। যেটা মানুষের মনোজগতের কেন্দ্রে থাকে। মানুষকে লক্ষ্যের দিকে টেনে নিয়ে যায়, সফল করে। সাহিত্যিক হতে হলে পড়তে হবে, লেগে থাকতে হবে, দৃষ্টিভঙ্গিকে শাণিত করতে হবে। দু-একটা গল্প লিখলেই লেখক হওয়া যায় না। নিয়মিত লিখে যেতে হবে। অনেক বাধা আসবে। কোনো কারণেই থামা যাবে না। লিখতে লিখতেই দক্ষ হবেন। মোটিভেশন বা ইচ্ছাশক্তি জোরালো হতে হবে। আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। লেখার মধ্যেও নিজের ভেতরের এই মনস্তাত্ত্বিক উপাদানগুলো ব্যবহার করতে হবে।
ভালো ভালো লেখকের বই পড়তে হবে। তাঁদের লেখার কলাকৌশল শিখতে হবে। তারপর তাঁদের ভেঙেচুরে নিজস্ব ঢঙে নিজের মতো করে কিছু লেখার চেষ্টা করতে হবে। হয়তো প্রথম দিকে লেখা ভালো হবে না। তবে ভরসা রাখতে হবে, এই লেখা কোনো একদিন সাড়া ফেলবে।
সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে ব্রেনের মেমোরি শাণিত করতে হবে। ভালো লেখকদের ব্যাকরণগত দিক, ক্রিয়াপদের কালরূপ দেখতে হবে, কীভাবে কালরূপটা তাঁরা ব্যবহার করেছেন; কেউ নিত্যবৃত্ত বর্তমান ব্যবহার করেছেন। রহিম বলে, সে চলে যাচ্ছে। রহিম বলল, সে চলে যাচ্ছে। এ বিষয়গুলো। কিছু আছে সাধারণ অতীতকাল। তাহলে ক্রিয়াপদের কোন রূপটা ব্যবহার করব? প্রথম থেকে এ বিষয়গুলো জানা থাকলে লেখার সময় এগুলো ব্যবহার করতে পারবেন।
কল্পনাশক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘বঁধু, কোন আলো লাগল চোখে!/ বুঝি দীপ্তিরূপে ছিলে সূর্যলোকে!’ এখানে কবিগুরু সূর্যলোকের দীপ্তির সঙ্গে বঁধুর রূপের তুলনা করেছেন। এটি কল্পনাশক্তির সৃজনক্ষমতা।
একজন লেখকের যুক্তি আরোপ করার ক্ষমতা থাকতে হবে। যুক্তি হতে হবে বাস্তবসম্মত। বাস্তবতাকে বিসর্জন দিয়ে সৃষ্টিশীল কিছু হবে না। অর্থপূর্ণ উপলব্ধি, সমস্যা সমাধান করার মাধ্যমে গল্পের কম্পোজিশন করতে হবে।
ছোটগল্প, গল্প ও উপন্যাস
• গল্প: তিন থেকে চার হাজার শব্দের হলে সেটাকে স্ট্যান্ডার্ড গল্প বলা যায়। তবে শব্দসংখ্যা নিয়ে ওইভাবে কোনো নিয়ম নেই। এটা একান্তই আমার মত। পত্রিকায় যেসব গল্প ছাপা হয়, সেগুলো অল্প শব্দের হয়। এটা পত্রিকার জায়গা অনুযায়ী সম্পাদকেরা চেয়ে থাকেন। তবে এটা স্ট্যান্ডার্ড নয়।
• ছোটগল্প: ছোটগল্প হলো ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা, ছোট দুঃখ, কথা থাকবে নিতান্তই সহজ–সরল। ছোটগল্পে টুইস্ট থাকবে, বাঁক থাকবে। ইঙ্গিতময় শেষাংশ থাকবে, শুরু থাকবে, মধ্যম থাকবে। শেষ হইয়াও হইল না শেষ—পাঠকের জন্য একটি অতৃপ্তি রেখে দেওয়া। আবার তৃপ্তি দিয়েও শেষ করা যায়। অনেকে বলেন, ছোটগল্প এমন হতে হবে যাতে ১০ থেকে ৫০ মিনিটের মধ্যে পড়ে শেষ করা যায়।
• উপন্যাস: ঈদ সংখ্যাসহ বিভিন্ন ম্যাগাজিনে ১০-২০ হাজার শব্দের যে উপন্যাস প্রকাশ করা হয়, সেগুলোকে উপন্যাসিকা হিসেবে ধরা হয়। স্ট্যান্ডার্ড উপন্যাস হতে গেলে কমপক্ষে ৪০-৫০ হাজার শব্দের হতে হবে।
সাহিত্য ও কথাসাহিত্য
ছড়া, কবিতা, নাটক, গল্প, উপন্যাস—সবই সাহিত্য। কথাসাহিত্য হলো কবিতা নয়, তবে বাক্য গঠনের মাধ্যমে আমাদের যে মনোজগৎ ও চারপাশের পরিবেশটাকে তুলে আনছি, জীবনটাকে তুলে আনছি, তার বিস্তীর্ণ প্রেক্ষাপট।
উল্লেখ্য, প্রথম আলো বন্ধুসভার ভার্চ্যুয়াল লেখালেখি কর্মশালার তৃতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হয় ১ জুন। কর্মশালায় ‘গল্প’ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন মনোরোগ চিকিৎসক ও কথাসাহিত্যিক মোহিত কামাল। ওপরের লেখাটি তাঁর আলোচনার প্রতিলিপি।