স্মৃতিতে অমলিন বিচারপতি ফজলুল করিম
উপমহাদেশবরেণ্য মুনশী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ স্মৃতিবিজড়িত পটিয়ার সুচক্রদণ্ডী গ্রামটি বেশ সুপরিচিত। শিক্ষা-দীক্ষা, সংস্কৃতি, হিতৈষী, মূল্যবোধ প্রভৃতি দিক দিয়ে গ্রামটি উর্বর। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের বংশধর তাঁরই ভাতিজা ঘরের নাতি বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম।
মোহাম্মদ ফজলুল করিম ১৯৪৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হাজী আহমেদ কবির ভূমি অফিসে চাকরি করতেন। মাতা ছুনিয়ারা বেগম। পিতার সান্নিধ্যে শৈশবে সুচক্রদণ্ডী গ্রামে বেড়ে ওঠা। বাবার চাকরির সুবাধে স্কুলবেলায় তিনি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করেছেন। ১৯৫৮ সালে এসএসসি, ১৯৬০ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৬২ সালে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ইসলামের ইতিহাস নিয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে গিয়ে আইন বিষয়ে পড়ালেখা করেন।
১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি (সম্মান) পাস করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য লন্ডনে চলে যান। ১৯৬৯ সালে তিনি লন্ডন থেকে ব্যারিস্টার অ্যাট ল পাস করে দেশে ফেরেন। ১৯৭০ সালে জানুয়ারি থেকে হাইকোর্টে উকালতি প্র্যাকটিস শুরু করেন। হাইকোর্টে তিনি খুব অল্পসময়ে আইন বিষয়ে তাঁর মেধার স্বাক্ষর রাখেন এবং আইন চর্চায় চারদিকে বেশ সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭৮ সালে তিনি সুপ্রিম কোর্টে এনরলন্ড এবং ১৯৯২ সালে হাইকোর্টে জজ হন। একই বছর তিনি বার কাউন্সিল সদস্য হন।
১৯৭৮ সালে সীতাকুণ্ড ফৌজদারহাটের কৃতী সন্তান দেওয়ানী আইনের জাদুকর ও তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরীর পঞ্চম কন্যা শামসুন নাহার চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ে হয়। বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম পাঁচ সন্তানের জনক। তাঁরা প্রত্যেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।
২০০১ সালে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হন মোহাম্মদ ফজলুল করিম। ২০১০ সালে তিনি বাংলাদেশের ১৮তম প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন। (৮.০২.২০১০—২৯.০৯.২০১৬) তাঁর উল্লেখযোগ্য রায়ের মধ্যে রয়েছে তামাকবিরোধী আইন, পতিতা উচ্ছেদবিরোধী তথা পতিতার অধিকার সংরক্ষণ আইন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়, বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী রায়।
ফজলুল করিম ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন সহজ–সরল, বিনয়ী একজন ধার্মিক মানুষ। মাঝেমধ্যে গ্রামের বাড়িতে এসে পূর্বপুরুষদের কবর জিয়ারত করতেন। গ্রামের তরুণদের উপদেশ দিতেন, পড়ালেখা করার জন্য, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য, দেশ ও জাতির কল্যাণে যাতে নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করতে পারেন। তরুণদের বলতেন, ‘পড়ালেখা না করলে অন্ধকারে সব হারিয়ে যাবে। পড়ালেখা করলে তোমরা আগামীর বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।’
বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম চট্টগ্রাম সমিতির আজীবন সদস্য ও ২০০৬ সালে ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি ছিলেন। চট্টগ্রাম সমিতির মূল ভবনটি নেওয়ার সময় অ্যাডভোকেট শাহ আজিজের কাছ থেকে বিচারপতি ফজলুল করিম প্রত্যক্ষ সহায়তা ও সহযোগিতা করেন। বাখরাবাদ থেকে চট্টগ্রাম কর্ণফুলি গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন করার পেছনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। গ্রামের মসজিদ-মাদ্রাসার উন্নয়নের জন্য ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিতেন। নিজের এলাকার মানুষ যে যখন কোনো সহযোগিতার জন্য যেতেন, তিনি হাসিমুখে সহযোগিতা করতেন।
আমার নানা বাড়ি সুচক্রদণ্ডী গ্রামে হওয়ায় মাঝেমধ্যে বিচারপতি ফজলুল করিমের সঙ্গে দেখা হলে কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন। সালাম দিলে হাসিমুখে উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, ‘তোঁয়ারা কেন আছো, গম আছো নি, চা চঁরি চলের নি ঠিকমতো বাসা হন্ডে?’
চট্টগ্রাম সমিতি ঢাকার মেজবানে তিনি নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন। হাইকোর্ট মাজার মসজিদের পরিচালনা কমিটির সভাপতিও ছিলেন। জুমার নামাজ তিনি হাইকোর্ট মাজার মসজিদে আদায় করতেন। ১২ রবিউল আউয়াল উপলক্ষে হাইকোর্ট মাজারে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) আয়োজনে তিনি সভাপতিত্ব করতেন।
একবার কাছের এক আত্মীয়ের সঙ্গে কাকরাইলয়ের প্রধান বিচারপতির বাসভবনে গিয়েছিলাম। বিচারপতি ফজলুল করিমের সহধর্মিণী শামসুন নাহার চৌধুরী আপ্যায়ন করালেন। তিনি স্মৃতিচারণা করে বললেন, ‘আল্লাহর কী রহমত, এই বাসভবনে আমার বাবা (ইমাম হোসেন চৌধুরী) প্রধান বিচারপতি থাকাকালীন শৈশব-কৈশোর কেটেছে। ২০১০ সালে আমার স্বামী প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর আবার একই বাসায় বসবাস করছি। এই বাসায় আমার অনেক স্মৃতি।’
গত বছরের ১৬ নভেম্বর বিচারপতি মোহাম্মদ ফজজুল করিম না–ফেরার দেশে চলে যান। দেশের খ্যাতিমান এই বিচারপতির প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
উপদেষ্টা, পটিয়া বন্ধুসভা