সবুজের স্বপ্নে ৭০ বছর

প্রকৃতিবন্ধু মুকিত মজুমদার বাবুছবি: সংগৃহীত

সেদিন গাজীপুরের পিরুজালিতে সকালটা ছিল রোদেলা, হালকা বাতাসে ভেসে আসছিল শিউলি ফুলের ঘ্রাণ। প্রকৃতি ও জীবন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের মেডিকেল টিমের সঙ্গে প্রকৃতিবন্ধু মুকিত মজুমদার বাবুর নেতৃত্বে আমরা গিয়েছিলাম পিরুজালি মাস্টারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। চারপাশে ছিল মানুষের ভিড়, গ্রামের শত শত দরিদ্র নারী-পুরুষের মুখে ছিল আশার আলো—আজ তাঁরা বিনা মূল্যে চিকিৎসা পাবেন, ওষুধ পাবেন। দিনভর সেই চিকিৎসা ক্যাম্প শেষে বিকেলের দিকে একটু বিশ্রাম নিতে আমরা গেলাম পাশের প্রকৃতিপল্লি রিসোর্টে।

অল্প সময়ের মধ্যেই সেখানে এলেন মাস্টারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকসহ কয়েকজন স্থানীয় মানুষ। তাঁরা অনুরোধের সুরে বললেন, ‘স্যার, আমাদের স্কুলের ১৫০ জন বাচ্চার জন্য সপ্তাহে এক দিন একটা করে ডিমের ব্যবস্থা করা যায়?’
মুকিত মজুমদার বাবু কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। চারপাশের শান্ত বিকেলে তাঁর মুখে চিন্তার ছায়া, চোখে মায়ার রেখা। তারপর বললেন, ‘সপ্তাহে এক দিন একটি ডিম দিয়ে কী হবে? ওরা তো আমাদের ভবিষ্যৎ। ওদের শরীর ও মনকে পুষ্ট হতে হবে প্রতিদিন। সপ্তাহে এক দিন নয়, প্রতিদিন দুপুরে ওদের জন্য পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করব। থাকবে ভাত, ডাল, সবজি, খিচুড়ি আর ডিম।’

কথাটা শুনে আমরা সবাই আনন্দিত হলাম। গ্রামের সেই স্কুলের শিক্ষক ও অভিভাবকেরাও আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। মুকিত মজুমদার বাবু শুধু প্রতিশ্রুতি দেননি—তাঁর সেই ঘোষণা বাস্তবায়ন হয়েছে। ২০২২ সাল থেকে আজও ওই বিদ্যালয়ের শিশুরা পাচ্ছে নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার। এই একটি ছোট্ট দৃশ্য যেন পুরো মানুষটিকে চিনিয়ে দেয়।

আমার কর্মজীবনের সৌভাগ্য—এমন একজন মানুষকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনে যোগদানের আগে একটি জাতীয় দৈনিকে কাজ করতাম। কিন্তু প্রকৃতি ও জীবন অনুষ্ঠান, মুকিত মজুমদার বাবুর কাজ, তাঁর চিন্তা আর মানুষের প্রতি ভালোবাসা আমাকে সব সময়ই আকৃষ্ট করত। তাই প্রস্তাব পেয়ে আর দেরি করিনি। ২০২২ সালের মার্চে যোগ দিই তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনে।

প্রকৃতি ও জীবনে যোগ দেওয়ার কিছুদিন পরের একটি সকাল মনে গেঁথে আছে। অফিসের জানালা দিয়ে দেখি, আমাদের এক স্টাফ পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদে চাল ছিটিয়ে দিচ্ছে। অসংখ্য পাখি এসে সেখানে খাবার খাচ্ছে। জানতে চাইলাম, ব্যাপারটা কী! তখনই জানলাম—এটি আমাদের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবু স্যারের নির্দেশে করা হয়। তিনি চান শহরের ধূসর জীবনে পাখিদের জন্যও থাকুক একটি নিরাপদ আশ্রয়, প্রতিদিনের আহার। তিনি নিয়মিত খোঁজ নেন খাবার ঠিকমতো দেওয়া হচ্ছে কি না। পাখি ও প্রাণীর প্রতি এমনই মমত্ববোধ তাঁর। এগুলো অল্প সময়ে আমার দেখা ছোট্ট দুটি উদাহরণ মাত্র। প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসার এমন অসংখ্য গল্প বলা যাবে। এই দুটি ঘটনার ভেতর দিয়েই আমি বুঝেছি, তাঁর কাজের পরিধি যত বড়ই হোক না কেন, প্রতিটি কাজের কেন্দ্রে আছে মানুষ ও প্রকৃতি।

মুকিত মজুমদার বাবু এখনো স্বপ্ন দেখেন, পরিকল্পনা করেন, মাঠে নেমে কাজ করেন—ঠিক একজন উদ্দীপ্ত তরুণের মতো
ছবি: সংগৃহীত

১৯৭১ সালে কিশোর বয়সে তিনি অংশ নিয়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নটর ডেম কলেজের পড়াশোনা শেষ করে উচ্চশিক্ষার্থে পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যে, পরে যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৮৪ সালে দেশে ফিরে শুরু করেন ব্যবসা—ইমপ্রেস গ্রুপের তিনি প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। কিন্তু তাঁর পরিচিতি কেবল একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে সীমাবদ্ধ নয়; তিনি দেশ-বিদেশে পরিচিতি লাভ করেছেন ‘প্রকৃতিবন্ধু’ হিসেবে। ব্যবসায়িক সফলতার চূড়ায় থেকেও তাঁর মন সব সময় ছিল প্রকৃতির পাশে। ২০০৯ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন, ২০১০ সালে চ্যানেল আইয়ে শুরু করেন পরিবেশবিষয়ক ধারাবাহিক প্রামাণ্য অনুষ্ঠান ‘প্রকৃতি ও জীবন’। এখন পর্যন্ত প্রায় চার শতাধিক পর্ব প্রচারিত এই অনুষ্ঠান আজ দেশের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রকৃতিভিত্তিক তথ্যচিত্র সিরিজ।

মুকিত মজুমদার বাবুর নেতৃত্বে প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন কাজ করছে নিরলসভাবে। বৃক্ষরোপণ, বন্য প্রাণী সংরক্ষণ, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, পরিবেশ শিক্ষা, প্রজাপতি পার্ক প্রতিষ্ঠা, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে তথ্যকেন্দ্র স্থাপন, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান ও চিড়িয়াখানায় গাছের পরিচিতি ফলক সংযুক্তি—প্রতিটি উদ্যোগই তাঁর সবুজ চিন্তার বহিঃপ্রকাশ।

শুধু প্রকৃতি নয়, মানুষও তাঁর কাজের কেন্দ্রবিন্দু। প্রকৃতি ও জীবন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে তিনি চালু করেছেন বিনা মূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ বিতরণ কর্মসূচি। এর মাধ্যমে প্রতিবছর গ্রাম ও চরাঞ্চলের হাজারো অসহায় মানুষ পাচ্ছে বিনা মূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ। করোনাকালে পাঠিয়েছেন চিকিৎসাসামগ্রী, বন্যায় দিয়েছেন ত্রাণ, প্রতি শীতে দিচ্ছেন শীতবস্ত্র। ‘পরিবেশবান্ধব বিকল্প আয়’ কর্মসূচির মাধ্যমে দরিদ্র পরিবারের হাতে তুলে দিচ্ছেন সেলাই মেশিন, গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি, রিকশা, ইজিবাইক—যাতে তাঁরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে।

মুকিত মজুমদার বাবুর উদ্যোগে সারা দেশে গড়ে ওঠা ‘প্রকৃতি ও জীবন ক্লাব’ দেশের তৃণমূল পর্যায়ে প্রকৃতি সংরক্ষণে এক বিপ্লব সৃষ্টি করেছে। ক্লাবের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ একত্রিত হয়ে পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখছে। প্রতিবছর বর্ষাকালে ‘সবুজে সাজাই বাংলাদেশ’ কর্মসূচির মাধ্যমে লাখো গাছের চারা রোপণের মতো মহতী উদ্যোগের জন্য এই ক্লাব পরিবেশ সুরক্ষার এক উজ্জ্বল মডেল হয়ে উঠেছে।

প্রতিবছর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর বই। ‘আমার অনেক ঋণ আছে’, ‘আমার দেশ আমার প্রকৃতি’, ‘সবুজে সাজাই আমার বাংলাদেশ’, ‘স্বপ্নের প্রকৃতি’, ‘সবুজ আমার ভালোবাসা’, ‘হৃদয়ে সবুজ বাংলা’—এসব কেবল রচনা নয়, এগুলো প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার এক জীবন্ত দলিল। ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিন ‘প্রকৃতিবার্তা’ ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘প্রকৃতিবার্তা ডটকম’ প্রকাশের মাধ্যমে পরিবেশ সচেতনতায় যোগ করেছেন নতুন মাত্রা। এ ছাড়া নিয়মিত প্রকৃতিবিষয়ক সুচিন্তিত মতামত, পরামর্শ ও অসংগতি তুলে ধরছেন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে।

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি প্রতিবছর অংশ নিচ্ছেন আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনে, বাংলাদেশের পরিবেশ ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছেন বিশ্বমঞ্চে। পরিবেশবিষয়ক কাজের স্বীকৃতি হিসেবে মুকিত মজুমদার বাবু ও তাঁর প্রতিষ্ঠান প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন জাতীয় পরিবেশ পদক-২০১২, এইচএসবিসি-দ্য ডেইলি স্টার ক্লাইমেট অ্যাওয়ার্ড-২০১২, ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন অ্যাওয়ার্ড-২০১৩, বিজনেস এক্সিলেন্সি অ্যাওয়ার্ড সিঙ্গাপুর-২০১৪, জাতীয় পরিবেশ পদক-২০১৫, ঢাকা আহছানিয়া মিশন চাঁদ সুলতানা পুরস্কার-২০১৫, ফোবানা অ্যাওয়ার্ড ইউএসএ-২০১৬, পল্লীমা গ্রিন স্বর্ণপদক-২০১৭, আ ফ্রেন্ড অব নেচার-২০২১, মার্ক অ্যাঞ্জেলো রিভার অ্যাওয়ার্ড ২০২৪-সহ বিভিন্ন সম্মাননা অর্জন করেছেন।

২৫ অক্টোবর তিনি ৭০ বছরে পা রাখলেন। সত্তরে পা রাখলেও তাঁর যাত্রা থেমে নেই। তিনি এখনো স্বপ্ন দেখেন, পরিকল্পনা করেন, মাঠে নেমে কাজ করেন—ঠিক একজন উদ্দীপ্ত তরুণের মতো। প্রতিবারের মতো এ বছরও তিনি সাভারের সিআরপিতে উইলিয়াম অ্যান্ড মেরি টেইলর স্কুলের পক্ষাঘাতগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জন্মদিনের আনন্দ ভাগাভাগি করেছেন। জীবনের এই মাইলফলকে দাঁড়িয়ে তাঁর চোখে এখনো সেই একই স্বপ্ন—একটি দূষণমুক্ত, সবুজ ও টেকসই বাংলাদেশ।

লেখক: সম্পাদক, প্রকৃতিবার্তা; সমন্বয়ক, প্রকৃতি ও জীবন ক্লাব