শিল্প কি হারিয়ে যাবে কোডের ভিড়ে

এআই নিয়ে আঁকা চিত্রছবি: রয়টার্স

মানুষের ইতিহাস কেবল সভ্যতার নয়, একে বলা যায় শিল্পের ইতিহাস। গুহাচিত্র থেকে গানের পঙ্‌ক্তি, কাদামাটি থেকে নাটকের ভাষা—মানুষ তার আত্মাকে চিরকাল রূপান্তরিত করে তুলেছে শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমে। অথচ আজ, এই শিল্পযাত্রার বাঁকে এসে প্রযুক্তি, বিশেষত আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই, এক নতুন সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে আমাদের শিল্পসত্তাকে। সবার মনে প্রশ্ন, সৃজনশীলতা কি আজ বিপর্যয়ের সম্মুখে?

শিল্প কি শুধু দক্ষতা, নাকি আত্মার উন্মোচন? যন্ত্র এখন কবিতা লিখছে, গান বাঁধছে, ছবি আঁকছে। এই দৃশ্য প্রযুক্তির জয়গান হতে পারে; কিন্তু দার্শনিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, এসব কি সত্যিকারের শিল্প? জার্মান দার্শনিক মার্টিন হাইডেগারের মতে, ‘শিল্প হলো সত্যের উদ্ভাস, অস্তিত্বের উন্মোচন।’ আর সেখানে মনুষ্য অনুভূতি, যন্ত্রণার অনুরণন, সময়ের অন্বেষণই আসল শিল্পের উৎস। কিন্তু এআইয়ের নির্মাণযজ্ঞ ‘বিগ ডেটা’ ও ‘অ্যালগরিদম’-নির্ভর। এতে আবেগের অনুকরণ রয়েছে, কিন্তু অনুভব নেই। একটা কবিতা যখন লেখা হয়, তখন কবির ভেতরে একটা অভিজ্ঞতা জন্ম নেয়, একটি স্বপ্ন ভাঙে, একটি প্রেম পুড়ে ছাই হয়ে যায়—সেই ছাই থেকে উঠে আসে শব্দ। কিন্তু এআই সেখানে ‘প্রেডিকশন’ চালায়। একে কি আমরা অস্তিত্ববাদী অর্থে শিল্প বলব?

ফরাসি দার্শনিক জঁ-পল সার্ত্র বলেছিলেন, ‘মানুষ প্রথমে অস্তিত্ব লাভ করে, তারপর নিজেকে গড়ে তোলে’। শিল্পও তাই। শিল্প আগে অস্তিত্ব অনুভব করে, তারপর রূপ নেয়। অথচ এআই প্রথমেই গঠিত হয় ‘কোড’ দিয়ে, তারপর শেখে কীভাবে রূপ নিতে হয়। শিল্পে যেখানে ‘অজানা’র রোমাঞ্চ থাকে, এআই সেখানে ‘ডেটা’র সুরক্ষা চায়। একে অস্তিত্ববাদের ছায়ায় দেখলে, তা আত্মাশূন্য দক্ষতাই বটে।

সমসাময়িক এআই প্রযুক্তি রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, কিংবা হুমায়ূন আহমেদের মতো প্রমুখ লেখকের লেখা অনুকরণ করতে পারে। কিন্তু তাঁদের ভাষার অভ্যন্তরের নৈঃশব্দ্য, নিঃসঙ্গতার অভিজ্ঞতা, সময়ের বিপন্নতা—এসব অনুকরণযোগ্য নয়। আমাদের সাহিত্য কি তবে প্রযুক্তির ছায়া হয়ে থাকবে? নাকি সে নিজেই হয়ে উঠবে প্রযুক্তি বিরোধিতার ভাষা? এখন সেটা প্রশ্নবিদ্ধ! তাহলে, এখন এআই কি শিল্পের মৃত্যুর পূর্বাভাস? ফরাসি সাহিত্যতাত্ত্বিক রঁলা বার্ত ‘লেখকের মৃত্যু’র কথা বলেছিলেন। এখন কি তবে ‘শিল্পীর মৃত্যু’র সময় এসেছে? নাকি নতুন শিল্পীর জন্ম হবে, যে যন্ত্রের ভেতরে থেকেও মানবিকতার বীজ বুনবে? এখন কি তাহলে আর প্রকৃত শিল্পস্রষ্টা তৈরি হবে না? যা হবে তা সবই প্রযুক্তিনির্ভর?

শিল্প কেবল ফলাফল নয়, এক উপলব্ধির নাম। সে সৃষ্টির চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ‘অসফলতার সাহস’, যা এআই দিতে পারে না। একটি মানুষের আঁকা একটি ভুল রেখাও অনেক সময় একটি যন্ত্রের নিখুঁত রেখার চেয়ে অনেক বেশি জীবনবোধ জাগায়। এআই হয়তো এক নতুন মাধ্যম। কিন্তু তাকে উদ্দেশ্য করে তুললে আমরা হেরে যাব। দরকার, শিল্পকে অস্তিত্ববাদের আলোয় নতুন করে ভাবা। মানবিক অনুভবের যান্ত্রিক অনুরণন থেকে নিজেকে আলাদা রাখা। লেখকের কলম, চিত্রশিল্পীর তুলি, কিংবা গায়কের কণ্ঠ—এসব কেবল উপকরণ নয়, এরা আত্মার বিস্তার। প্রযুক্তি আসুক সহায়তা হয়ে, কিন্তু প্রতিস্থাপন হয়ে নয়।

শিল্পের সবচেয়ে বড় শক্তি তার আত্মিকতা, যা কোনো অ্যালগরিদম ধারণ করতে পারে না। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স হয়তো ভালোভাবে অনুকরণ করতে পারবে, কিন্তু সৃষ্টি নয়। আমাদের শিল্পসত্তা টিকে থাকবে, যদি আমরা আত্মার দীপ্তি ভুলে না যাই। আমরা যদি আমাদের ভেতরের মানুষটিকে বাঁচিয়ে রাখি, তাহলে কোনো যন্ত্রই আমাদের শিল্পসত্তাকে পরাজিত করতে পারবে না।

শিল্প যেখানে আত্মার উন্মোচন, সেখানে যন্ত্র কেবল নিরুত্তর অনুকরণ। কারণ, অস্তিত্বের দাহ, প্রশ্নের রক্ত, আর সৃষ্টির নিঃসঙ্গতা কোনো অ্যালগরিদম ধারণ করতে পারে না।

বন্ধু, দিনাজপুর বন্ধুসভা