বাবাকে কখনো ভালো খাবার খেতে দেখিনি
বাবাকে কখনো পেট ভরে কোনো সুস্বাদু কিছু খেতে দেখিনি। আমরা যেমন মৌসুমি ফল কিংবা অন্য কোনো মজার খাবার খাই। গ্রীষ্মকালে আম খেতে দিলে বলেন, ‘তোমরা খাও, আমরা ছোটবেলায় যা খেয়েছি তা তোমরা চোখেও দেখো নাই।’ এই বলে আমের খোসায় লেগে থাকা দু-এক চিমটি আম মুখে নিতেন। ঘরে থাকতে থাকতে অবহেলিত কলা যখন কালো হয়ে যেত, তখন ফেলে দেওয়ার আগে সেই কলা খেতেন। বাবার অফিসের কোনো উৎসব আয়োজনে একা কখনো খেতেন না। এমনকি পবিত্র রমজান মাসের ইফতারিও একা খেতেন না। আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতেন অথবা খাবারটা বাসায় নিয়ে আসতেন।
মিল্ক চকলেটের প্যাকেটে দুটি স্ট্র দিয়ে দুই বোনকে বলতেন, দেখি কে কত দ্রুত খেয়ে শেষ করতে পারো। এই প্রতিযোগিতায় হারজিত দেখার চেয়ে বাবার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাড়াতাড়ি আমরা যেন খেয়ে শেষ করি। ওনার এই চালাকি আমরা ধরতে পারতাম না। নিজে না খাওয়ার অগণিত চালাকি জানতেন এই সহজ–সরল মানুষটা। প্রতিবছরের সব ফল কিংবা বিখ্যাত সব খাবার অন্তত একবার করে হলেও আমাদের খাওয়াতেন। সেটা হোক যত দামি আর সস্তা। শুধু বাবাকে কখনো শখ করে পেট ভরে খেতে দেখিনি।
আমরা তিন ভাইবোন তখন বড় হয়ে গেছি। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর একদিন বাবা তাঁর হোমিওপ্যাথির দোকানে বসে ঝালমুড়ি মুখে নিচ্ছিলেন। আমার চোখে চোখ পড়তেই লজ্জায় কোথায় লুকাবেন খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ঝালমুড়ি খাওয়া দোষের কিছু নয়, কিন্তু উনি ভাবছিলেন আমি হয়তো ভাবতে পারি, তিনি আমাদের রেখে প্রায়ই খেয়ে থাকেন অথবা অন্য কিছু। কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, ‘আমি এগুলো খাই না, ঝালমুড়িওয়ালা জোর করে খাওয়াচ্ছে।’ নিষ্পাপ শিশু যেমন করে অভিভাবকের কাছে দোষ লুকায়, ব্যাপারটা অনেকটা তেমনই। ঝালমুড়ি খাওয়াতে এত সংকোচ কিসের, তার উত্তর খুঁজে পাইনি।
বাড়ির কর্তার জন্য যেমন যত্নে তুলে রাখা হয় খাবারের উৎকৃষ্ট অংশটুকু, সেটুকু বাবার প্লেটে কখনো দেখিনি। ওনার মুখে শুধু গল্প শুনেছি, এক কেজি মিষ্টি কীভাবে এক বসায় খেয়ে শেষ করতেন অথবা এক বোল গরুর মাংস! ওনার বেছে বেছে মুরগির চামড়া আর গলা খাওয়া দেখলে মনে হয়, বাবাদের বুঝি লেগ পিস খাওয়া বিশাল অপরাধ!
এখন বাবার শক্তিশালী পেশি দুর্বল হয়ে গেছে। ডায়াবেটিস, ব্লাডপ্রেশার আরও কত কী সামান্য অজুহাতে তাঁকে কাবু করে বসে, তা আমাদের কান পর্যন্ত আসে না। জানা হয় না জানা–অজানা কত আরাম–আয়েশ কিংবা শখ–আহ্লাদ ত্যাগ করা মানুষটার অনুভূতি।
আচ্ছা, সব সময় স্বাস্থ্য সচেতন মানুষটির কি কখনো কাঁচা পেঁয়াজ দিয়ে পুরি-শিঙাড়া খেতে ইচ্ছা করে? কখনো কি রাস্তার পাশে ফুটপাতের খাবার খেতে ইচ্ছা করে? অথবা কোনো বুফে, দামি রেস্টুরেন্টে কিংবা কেমিক্যালের ভয়ে এড়িয়ে যাওয়া টসটসে রসালো পাকা কোনো ফল?
আজকাল অফিসের কাজে দেশি-বিদেশি ক্লায়েন্টদের সঙ্গে মিটিংয়ের সুবাদে কত কিছু খাই। কাচ্চি–বোরহানি, বিরিয়ানি, মোগলাই, বার্গার বা পিৎজা, জনপ্রিয় চুইঝালের গোশত কবজি ডুবিয়ে তৃপ্তি নিয়ে খেয়ে ফেলি। এই খাওয়ার যেন শেষ নেই। একটার পর একটা লিস্টে চলে আসে। আরে ইনকাম করি, খাব না! খাওয়ার বয়স তো এখনই! এত এত টক–ঝাল–মিষ্টি স্বাদের ভিড়ে ভুলে যাই এত কিছু ত্যাগ করা মানুষটারও কিছু খাওয়ার ইচ্ছা থাকতে পারে। ভুলে যাই, সারা দিন রোজা রাখার পর, সন্ধ্যায় অফিসের ইফতারিটা যত্ন করে তিনি নিয়ে আসতেন। আমরা ভাইবোন মিলে গপ গপ করে খেতাম। ভুলে যাই অতীতের কথা।
হঠাৎ হুঁশ ফিরলে সাহস করে যখন বাবার জন্য কিছু কিনতে শিখলাম। দেখলাম, তিনি তৃপ্তি করে খেতে পারেন না। মধ্যবিত্ত পরিবারের রক্ষণশীল বাবাদের কন্যাসন্তানের উপার্জনের টাকা গলা দিয়ে ততটা সহজে নামে না, যতটা পুত্রসন্তানের উপার্জনে নামে। তাঁরা বয়সের ভারে কুঁজো হলেও আত্মসম্মানের বেলায় শিড়দাঁড়া শক্ত করে থাকেন। বাবাকে এখনো মন ভরে খেতে দেখি না।