ফিচার কীভাবে লিখব? ফিচার লেখার কৌশল

লেখালেখি কর্মশালার প্রথম পর্ব ।

ধরুন, আপনি বাসা থেকে বের হলেন, রাস্তায় নেমে একটা রিকশায় উঠলেন এবং একটা সময় গন্তব্যে গেলেন। মনে হবে এটা খুবই সাধারণ ঘটনা। তবে একজন ফিচার লেখক এ ঘটনার মধ্য থেকেই লেখার জন্য কিছু না কিছু বের করে ফেলতে পারবেন। যেমন রিকশায় হয়তো সুন্দর পেইন্ট করা ছিল। রিকশা পেইন্টিংয়ের মধ্যে রং, সময়কাল, চরিত্র চলে আসে। তারপর কথায় কথায় রিকশাচালক হয়তো আপনাকে এমন কিছু বললেন, যেমন তাঁর সন্তান কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেলেন অথবা কিছু অর্জন করলেন। আপনার অজান্তেই ফিচার লেখার রসদ চলে এল কিন্তু। পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা থাকলে সেখান থেকেই একটা সুন্দর ফিচার লিখে ফেলতে পারবেন।

‘যাঁর দেখার চোখ আছে, তাঁর জন্য লেখার অনেক সুবিধা। দেখতে না পারলে লিখতে পারবেন না। একই সঙ্গে দূরের এবং কাছের জিনিসকে দেখতে পারার ক্ষমতা থাকতে হবে।’

ফিচার লেখার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও দক্ষতা
‘আমার শিক্ষকেরা বলেছিলেন, সারা দুনিয়াই ফিচারের কারখানা। ফিচার সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে আছে। যেকোনো বিষয়তেই সুন্দর ফিচার লেখা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস হচ্ছে ভাষার ওপর দক্ষতা, যে ভাষাতেই লেখেন না কেন। ভাষা নিয়ে খেলতে জানতে হবে। প্রাণোচ্ছল ভাষায় লিখতে জানতে হবে। নিরীক্ষণধর্মী, প্রবন্ধের মতো লিখতে গেলে কিন্তু সেটা আর ফিচার হবে না।’

‘দ্বিতীয় যে বিষয়টা লাগবে সেটা হলো পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। আবার কিছু বিষয় আছে নিউজের জন্য যা, ফিচারের জন্যও তাই। এখন প্রশ্ন হতে পারে, নিউজ লেখার জন্য তো সত্য ঘটনা লিখতে হবে; ফিচারের জন্য কী লাগবে? ফিচার সাংবাদিকতারই অংশ। অবশ্যই সত্য ঘটনা তুলে আনতে হবে। কীভাবে? সত্যভিত্তিক ছোটগল্প লেখা যায়। তখন দেখবেন লেখার মধ্যে আঁটসাঁট ভাবটা কমে যাবে।’

ফিচার লেখার কাঠামো
নিউজের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো লেখার শুরুর দিকেই বলে দিতে হয়। এটাকে বলে ইনভার্টেড পিরামিড কাঠামো। ফিচারের ক্ষেত্রে হবে উল্টো। লেখা শুরুর পর ধীরে ধীরে মূল ঘটনা নিয়ে আসতে হবে। এমনভাবে লেখার তথ্যগুলো সাজাতে হবে, যাতে পাঠক পড়তে আগ্রহী হয়। ফিচার লেখকের নিজস্ব একটা ধরন থাকতে হবে। একজনের লেখার সঙ্গে আরেকজনের মিল হওয়া যাবে না। তবে একটা কাঠামো আছে।

• শিরোনাম: শিরোনাম এবং লেখার শুরুটা অবশ্যই আকর্ষণীয় হতে হবে।
• ইন্ট্রো: এটি হতে হবে ক্যাচ দ্য আই। অর্থাৎ দেখেই যেন চোখ আটকে যায়। সর্বোচ্চ ১৫-১৬ শব্দের মধ্যে। বেশি বড় হওয়া যাবে না।
• হোল দ্য অ্যাটেনশন: লেখার মধ্যে পাঠককে ধরে রাখতে হবে। যাতে সে বের না হয়ে যায়। এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, বিশেষজ্ঞদের মতামত দিতে হবে।
• ইন্টারেস্ট গ্রো: পাঠকের আগ্রহকে আরও জাগিয়ে তুলতে হবে। পাঠক যেন মনে না করে তার সময় নষ্ট হচ্ছে। কিছু না কিছু নতুন তথ্য লাগবে।
• উপসংখ্যার: পাঠকের বিশ্বাস অর্জনের পর শেষটায় একটা রহস্যও রাখা যেতে পারে। শেষ হইয়াও হইল না শেষ। এ জন্য বলা হয়, ছোটগল্পের সঙ্গে ফিচারের একটা মিল আছে। রহস্য না হলেও এমন একটা ভালো লাগা দিয়ে শেষ করতে হবে, যেটা পাঠকের দীর্ঘ সময় মনে থাকবে।

ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা অন্য নির্দিষ্ট বিষয়ে ফিচার লেখার ক্ষেত্রে করণীয়
কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে ফিচার লেখার জন্য ওই ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেওয়ার আগে তাঁর সম্পর্কে আগে জেনে যেতে হবে। যার সম্পর্কে লিখব, যে বিষয়টা নিয়ে লিখব, যে প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে লিখব, তার সম্পর্কে আগে খোঁজখবর নিতে হবে। হোমওয়ার্ক না করে গেলে ওই মানুষটির আস্থা অর্জন করা সম্ভব হবে না। তখন সেই লেখা কোনো দিন ভালো হবে না। এটাকে বলে সমানুভূতি। এটা খুবই জরুরি।

‘ফিচার অনেকটা গল্প লেখা বা উল বুননের মতো। একটানা লিখে গেলে হবে না। কোন শব্দের পর কোন শব্দ বসবে, কোন বাক্যের পর কোন বাক্য বসবে, কোন ঘটনার পর কোন ঘটনা বসবে—এসব নিয়ে খেলতে হবে। কাউকে নিয়ে ফিচার করার জন্য সাক্ষাৎকার নিতে গেলে নোট নিতে হবে। আজকাল অনেকে রেকর্ড করে। তবে সঙ্গে নোটও নিতে হবে। বিশেষ করে মূল পয়েন্টগুলো। নোট নিলে মনোযোগটা থাকে। পরে লিখতে বসলে এই নোটগুলোই আপনাকে গাইড করবে। লেখায় মানবিক গল্প নিয়ে আসতে হবে।’

ফিচার যেকোনো বিষয়তেই লেখা যায়। যেমন আপনি গিয়েছেন এক কাজে। গিয়ে দেখা গেল অন্য আরেকটি বিষয় নজরে এল। মনে হলো সেটা নিয়েও লেখা যায়। কোনো একটা জায়গায় গেলে দেখার চেষ্টা করবেন ওই পরিবেশটা কেমন, যে বাড়িতে গেলাম, ওই বাড়ির পর্দার রং কেমন ছিল, চায়ের কাপ কোন রঙের ছিল? এতে ওই বাড়ির মানুষের রুচিবোধ বোঝা যায়। বইয়ের তাক, দেয়ালে টাঙানো ছবি—এগুলো পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তাহলে ফিচার লেখার জন্য কোনো না কোনো উপাদান পেয়ে যাবেন।’

বেশি বেশি মানুষের জীবনের গল্প শুনতে হবে। অভিজ্ঞতার চেয়ে বড় গল্প আর কিছু নেই।

উল্লেখ্য, প্রথম আলো বন্ধুসভার ভার্চ্যুয়াল লেখালেখি কর্মশালার প্রথম পর্ব অনুষ্ঠিত হয় ২৮ মে। কর্মশালায় ‘ফিচার’ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক সুমনা শারমীন। ওপরের লেখাটি তাঁর আলোচনার প্রতিলিপি।