শৈশবের ঈদ মানেই ছিল গ্রাম। আলগা ধুলোমাখা রাস্তায় ছুটে বেড়ানো, কাঁচা ঘাসের ভেজা গন্ধ, আর লাউয়ের মাচা পেরিয়ে ভেসে আসা মসজিদের আজান। শহরের ঈদ কেমন—সে ধারণাও ছিল না তখন। জানতাম শুধু, আমাদের ঈদ মানে মাঠের গরু, খড় কাটার হইচই, আর শিশুমনে লুকিয়ে থাকা শত আনন্দের গোপন উৎসব।
এখনো মনে পড়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময়কার ঈদের কথা। জিলহজ মাসের চাঁদ ওঠার আগেই গ্রাম জেগে উঠত অন্য রকম উৎসবে। চারদিকে গরু কেনাবেচার ধুম। স্কুল ছুটি, মাঠ হাটে রূপ নিত। আমাদের বাড়িরও একটি গরু বিক্রি হবে বলে ঠিক হলো। বাবার হাত ধরে রওনা দিলাম হাটের দিকে—প্রায় ১০ মাইল কাঁচা রাস্তা, ধুলার মধ্যে পায়ে-পায়ে কৌতূহল।
হাটে গিয়ে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল! কত শত গরু—সাদা, টকটকে লাল, কখনো গলায় মালা, মাথায় চাটাইয়ের টুপি, পেছনে রঙিন ফিতা। চারদিকজুড়ে মাইকে ভেসে আসে কোরবানির গান, গরুর দরের ঘোষণা, আর মানুষের গলা মিলিয়ে একরকম উৎসবমুখর হট্টগোল। একবারেই অন্য রকম আনন্দ—খাঁটি, প্রাণবন্ত, ছেলেবেলার মতোই নিষ্কলুষ।
আমাদের গরুটি ছিল দুধে-আলতা রঙের মতো লালচে। বাবা সেটি বিক্রি করলেন ২২ হাজার টাকায়। তারপর বাবা-মেয়ে মিলে খেলাম হোটেলের মোরগ পোলাও। তৃপ্ত পেট, খালি পা, হাতে বাবার শক্ত মুঠো—সে পথ যেন ছিল হৃদয়ের কোনো গোপন সঞ্চয়।
এরপর আমরা নিজেরাও একটি গরু কিনলাম। চারটি পরিবার ভাগ হয়ে কোরবানি দেবে। আমরা ছেলেমেয়েরা তখন ভরপুর উত্তেজনায়; কে খড় কাটবে, কে গরু আনবে, কোথায় রাখব!
গরু রাখা হলো নেজাম চাচার ঘরে। তাঁদের বাড়িতেই গরু রাখার ঐতিহ্য। ঈদের দুই দিন আগে গরু আনতে গেলেন বাবা, চাচারা, আর বড় ভাই ইদ্রিস। আমাদের কাউকে নেননি। ছোটদের দুঃখ কি আর ছোট? সবাই মিলে অভিমান করলাম—আমরা কি একবারও দেখতে পারতাম না, সেই গর্বিত যাত্রাপথ?
গরু এল মাগরিবের পর। নিঃশব্দ অভিমানে, কাউকে কিছু না বলে কাজিনদের নিয়ে গোপনে গিয়ে দেখলাম গরুটিকে। অন্ধকারে তার চোখে তারার মতো আলো, গলায় বাঁধা ঘণ্টির শব্দ যেন কোনো প্রাচীন সুরের মতো কানে বাজছিল।
পরে বাবা জানতে চাইলেন, ‘কার সঙ্গে গেছ?’
বললাম—‘একাই।’
ঈদের আগের সকাল থেকে শুরু হলো উৎসবের ঢেউ। সবাই মিলে খড় কাটছি, কেউ কাঁচি হাতে, কেউ পলিথিনে ভরছে, কেউ গরুর মুখের দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। আমরাও খড়ের মালা বানিয়ে পরিয়ে দিলাম গরুকে। রোজই দেখতে যেতাম তাকে—সে কাঁদছে কি না, বুঝতে চাইতাম।
নূর চাচা যখন গরুকে গোসল করাতেন, আমরাও যেতাম পেছনে পেছনে। মসজিদের পুকুরঘাটে দাঁড়িয়ে গরুকে ধুতাম, পানি এগিয়ে দিতাম, মাছি তাড়াতাম। সে যেন গরু নয়—আমাদেরই পরিবারের কেউ।
অবশেষে এল সেই সকালের প্রতীক্ষা—ঈদ! নতুন জামা পরে ছুটে গেলাম কোরবানির মাঠে। হুজুর যখন ছুরি চালালেন, চোখ ঢেকে ফেললাম; আবার রক্তমাখা দৃশ্যের বিস্ময়ে তাকিয়েও রইলাম। সে এক মিলন—ভয়, মমতা আর বিস্ময়ের।
আজ আমি ঢাকায়। ঈদ আসতে আর মাত্র এক দিন বাকি। সেদিন সকালে ক্লাসে যেতে যেতে দেখি, শহরের ফুটপাতে বাঁধা বড় বড় গরু। কেউ তাদের জন্য ছায়া খুঁজছে, কেউ মহিষের সামনে ঘাস ফেলছে। এক ভ্যান এসে থামল, তার ভেতরে সাজানো রঙিন খড়—আঁটি করে বিক্রি হচ্ছে।
আমি থমকে দাঁড়াই। চোখ বন্ধ করে দেখি—মাঠ, ধুলো, পুকুর, কাঁচা রোদ, বাবা, গরু, মোরগ পোলাও...।
এ শহরে ঈদ ঠিকই আসে। কিন্তু আমার শৈশবের ঈদ কি আর ফিরে পাব?
শিক্ষার্থী, ফিজিওথেরাপি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়