যেকোনো সংবাদ তৈরি হয় রাজনীতি থেকে। রাজনীতি মানে কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলের বক্তব্য-বিবৃতি নয়। যেমন আপনি দেখলেন রাস্তায় এক অসহায় মহিলা পড়ে আছেন। এ রকম কিন্তু অনেক মহিলা রাস্তাঘাটে পড়ে থাকেন। এটাও একটা প্রতিবেদন হতে পারে। কীভাবে?
এই মহিলাদের ভাতা পাওয়ার কথা। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হতে যাচ্ছে। এ ধরনের মহিলাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে চলে আসার কথা। এখানেই রাজনীতি। সরকার তাঁদের জন্য কিছু করছে না। আপনি রাস্তার পাশে পড়ে থাকা মহিলার গল্প শুনলেন। জানলেন, পরিবার তাঁর দায়িত্ব নেয়নি, রাষ্ট্রও তাঁর দায়িত্ব নেয়নি। উনি যে জেলা-উপজেলা বা ইউনিয়ন পরিষদের মানুষ, সেখানে গিয়ে ওনার ভাতা পাওয়ার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞেস করলেন, ওনাকে কি দারিদ্র্য কর্মসূচির আওতায় ঘর দেওয়া হয়েছে? ঘর না দিলে কেন দেওয়া হয়নি? ঘর পাওয়ার আর যোগ্য কে আছেন? ঘর কারা পেয়েছেন? পরে দেখা গেল, দু-চারজন সচ্ছল ব্যক্তিও ঘর পেয়েছেন। এভাবেই ছোট ছোট ঘটনা থেকে একটি বড় অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি হতে পারে।
সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো অনুসন্ধানী, বিশ্লেষণধর্মী, মানবিক, সরেজমিন এবং বড় কোনো ঘটনার প্রতিবেদনকে একটা জায়গায় নিয়ে আসা। মারামারি ও সহিংসতার ঘটনায় মৃত্যুর খবরের তথ্য তিনটি জায়গা থেকে নিশ্চিত হতে হবে। এক. পুলিশ যদি স্বীকার করে। দুই. হাসপাতাল যদি বলে যে এতজন মারা গেছে। তিন. নিহতের স্বজনদের বক্তব্য।
সংবাদ প্রতিবেদন লেখার নিয়ম
প্রতিবেদন লেখার ক্ষেত্রে কিছু বেসিক নিয়ম রয়েছে। এক. ফাইভডব্লিউএইচ। দুই. ইনভার্টেড পিরামিড কাঠামো। এই কাঠামোতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো শুরুতে দিতে হবে এবং শেষ করতে হবে কম গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে। তবে এই কাঠামো অনেক পুরোনো। সৃজনশীলতা হলো, এটা ভেঙে আপনি কী করতে পারছেন। তবে কাঠামোর ভেতরেই থাকতে হবে। ভেতরে থেকে নতুন সৃজনশীল কী করতে পারছেন, সেটাই হলো আপনার দক্ষতা।
বেসিক প্রতিবেদন লেখার ক্ষেত্রে, কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়ার পর সেখানে আলোচকেরা কী কী বললেন। কোনো দুর্ঘটনা হলো, কতজন মারা গেল। এগুলোর ক্ষেত্রে ইনভার্টেড পিরামিড কাঠামো ঠিক আছে। তবে বিশেষ প্রতিবেদন, সরেজমিন প্রতিবেদন, বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন, মানবিক প্রতিবেদন—এগুলোর ক্ষেত্রে পুরোনো স্ট্রাকচারটা এখন আর উপযোগী নয়।
অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করার কৌশল
• একজন রিপোর্টারকে কোনো অনুষ্ঠানে গেলে প্রথমেই আয়োজকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদের একটা মোবাইল নম্বর নিয়ে নিতে হবে। পরে যদি কোনো ছবি, কোনো রেকর্ড অথবা কারও বক্তব্য মিস করে ফেলেন, তখন যাতে ফোন দিয়ে তথ্যগুলো নেওয়া বা নিশ্চিত হওয়া যায়।
• অতিথিদের পরিচয়, নাম ফোনের মাধ্যমে সঠিকভাবে জেনে লেখাটাই ভালো। যাঁরা খুবই পরিচিত, সেটা তো রিপোর্টাররা জানেনই। যাঁদের চেনেন না, তাঁদের তথ্য ফোনের মাধ্যমে জেনে নেওয়া।
• আলোচকের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। নোট নিতে হবে। পাশাপাশি প্রত্যেক বক্তার বক্তব্য আলাদা আলাদা রেকর্ড করতে হবে। বক্তার কোনো সেনসেটিভ কথা থাকলে সেটা রেকর্ড শুনে লেখা ভালো। তাহলে ভুল হবে না। কারণ, ভুল নিয়ে পরে অনেক ঝামেলা হয়। বক্তব্য মিসডলিড হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিতর্ক তৈরি হয়।
• রেকর্ড শোনার ক্ষেত্রে, দেখা গেল বক্তা পাঁচ মিনিট সময়ে গিয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বা সেনসেটিভ কথা বললেন। সময়টা তখন নোট করে রাখতে হবে। পরে লেখার সময় পুরো বক্তব্য আর শুনতে হলো না। সরাসরি পাঁচ মিনিটে গিয়ে তথ্যটা শুনে লিখে ফেলা যায়। এভাবে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন লেখা যায়।
• ঘটনাস্থল থেকে একটি বা দুটি প্রতিবেদন অনলাইনের জন্য সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দিতে হবে। তখন ফোনের মাধ্যমে প্রধান রিপোর্টারের সঙ্গে আলাপ করে নেওয়া—কোন বিষয়টা শিরোনাম হবে, কোন বিষয়টা ইন্ট্রো হতে পারে। পরে অফিসে এসে পূর্ণাঙ্গ একটি প্রতিবেদন লিখতে হয়। অনলাইনে ছোট করে ১০০ থেকে ২০০ শব্দের একটা নিউজ চলে যায়। পরে অফিসে এসে পূর্ণাঙ্গ স্টোরিতে অন্য বিষয়গুলো থাকে। সবচেয়ে আলোচিত বিষয়টা নিয়ে অনলাইনে স্টোরি হয় আগে।
• ফটোগ্রাফার অ্যাসাইন করা না থাকলে রিপোর্টারের নিজেকেই ছবি তুলতে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফটোগ্রাফার অ্যাসাইন করা থাকে না।
অ্যাসাইনমেন্টে প্রতিবেদন লেখার সহজ সূত্র
অনুষ্ঠানে থাকতেই ঠিক করে ফেলতে হবে বক্তার বক্তব্যের কোন অ্যাঙ্গেলগুলো বড় হতে পারে। যেমন বাজেট নিয়ে কথা বললেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বললেন, আবার দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বললেন। তখন দেশে চলমান যে আলোচিত বিষয় থাকবে, সেটাকে বেশি ফোকাস করতে হবে। নোট নিতে হবে কোন বিষয়গুলো গুরুত্ব পেতে পারে। পরে প্রধান রিপোর্টারকে জানানো যে এটা এটা গুরুত্বপূর্ণ এবং এটা দিয়ে শিরোনাম-ইন্ট্রো করা যায়। যদি প্রধান রিপোর্টারকে কিছু বলতে না পারেন, তাহলে কিন্তু আপনার দক্ষতা নিয়ে একটা নেগেটিভ ধারণা তৈরি হবে।
একটা অনুষ্ঠানের রিপোর্ট লেখার ক্ষেত্রে, সেখানে মূল প্রবন্ধ কে পাঠ করেছেন, সঞ্চালক কে ছিলেন, কে আলোচক ছিলেন, কার সভাপতিত্বে হয়েছে—এ বিষয়গুলো সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। আলোচনা অনুষ্ঠানের শিরোনামও উল্লেখ করতে হবে। এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ।
অনুসন্ধানী প্রতিবেদন
কোন বিষয়টা নিয়ে অনুসন্ধান করব, সেই সিদ্ধান্ত আগে নিতে হবে। বিশেষ করে দুর্নীতির ক্ষেত্রে সরকারি বিভিন্ন নথিপত্র পাওয়ার পর সেটার ওপর নির্ভর করে অনুসন্ধান করা। অথবা কোনো সোর্সের কাছ থেকে কিছু একটা শোনা। পরে সেটা ধরে এগোনো।
যেমন কোনো একটা এলাকার অপরাধ চক্র নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে হবে। তখন ওই নির্দিষ্ট এলাকায় যেতে হবে। ভুক্তভোগীদের বাড়িতে যাওয়া, পুলিশের কাছে যাওয়া, রাজনৈতিক নেতাদের কাছে যাওয়া বা অন্যান্য সূত্রের কাছ থেকে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করা আসলে এগুলো কীভাবে হচ্ছে, কতজন মারা গেছে, সবচেয়ে বড় উৎস কারা, থানায় কয়টি পুলিশ কেস হয়েছে। আবার যারা অপরাধী, তাদের কারও সঙ্গে যদি যোগাযোগ স্থাপন করা যায়, সেটাও হতে পারে। এর আগে বিভিন্ন গণমাধ্যমে কী কী তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, সেসব জেনে নেওয়া।
মানবিক প্রতিবেদন
জুলাই অভ্যুত্থানের সময় যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের প্রায় প্রত্যেকের বাড়িতেই প্রথম আলোর প্রতিবেদকেরা গিয়েছিলেন। তাঁদের মা-বাবার সঙ্গে কথা বলেছেন, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলেছেন, ঘটনাস্থলে যাঁরা ছিলেন তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এভাবে সব তথ্যসহ পুরো বিষয়টা তুলে আনা। প্রতিবেদনে মানুষ ও মানবিকতার গল্পটা বেশি থাকবে।
এ ধরনের প্রতিবেদনে হার্ড রিপোর্ট হয় না। তবে কিছুটা ঢং আছে। ভুক্তভোগী যেটা দাবি করবে, সেটাকেই কিন্তু পুরোপুরি সত্য বলে মেনে নেওয়া যাবে না। সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ঘটনাস্থলের প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা ও পুলিশের বক্তব্য নিতে হবে।
ক্রসড চেক করাটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেটা দ্বিতীয় বা তৃতীয় কোনো মাধ্যম থেকে নিতে হবে। যদি সেটা না পাওয়া যায়, তখন ভুক্তভোগীর ভাষ্য এবং যাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবেদন, তাঁর ভাষ্য আলাদাভাবে নেওয়া। উভয় পক্ষের তথ্য ঠিক আছে কি না, তা যাচাই করা।
সরেজমিন প্রতিবেদন
নিজের দেখাটাই বড় কথা। আমি কী দেখলাম। দেখে বর্ণনা দেওয়া। যেমন একজন বৃদ্ধ মহিলাকে নিয়ে আপনি লিখলেন, উনি অসুস্থ, ওনাকে দেখার কেউ নেই। এটাকেই কিন্তু আবার জাতীয় রূপ দেওয়া যায়। একজন ব্যক্তির জীবন, তাঁকে ধরেই আপনি বাংলাদেশের প্রবীণ নাগরিকদের সংখ্যা নিয়ে এলেন। তাঁদের মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তার ভাতা পাচ্ছেন কত শতাংশ। তখন সারা দেশের প্রবীণ মানুষদের অবস্থা নিয়ে একটা ধারণা পাওয়া যাবে। তারপর আবার ওই বৃদ্ধ মহিলার গল্প লেখা শুরু করলেন।
যেকোনো ধরনের প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে কারও বক্তব্যকে শতভাগ বিশ্বাস করা যাবে না। রিপোর্টারের মনে প্রশ্ন জাগতে হবে। প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে দ্বিতীয় বা তৃতীয় পক্ষ থেকে ক্রসড চেক করতে হবে।
সংবাদ প্রতিবেদকের যেসব গুণ থাকতে হবে
একজন সাংবাদিকের সবচেয়ে বড় গুণ তাঁর নিউজসেন্স থাকা। কোন বিষয়টা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, কোন বিষয়টা সামনে দেওয়া দরকার—এই পলিটিকস বুঝতে হবে। নয়তো রিপোর্টার হওয়া যাবে না। পত্রিকায় ছাপা প্রতিবেদন বেশি বেশি পড়তে হবে। তাহলে প্রতিবেদন লেখা নিয়ে একটা ধারণা তৈরি হবে।
দিন শেষে ব্যক্তির সৃজনশীলতা টিকে থাকে। সে জন্য প্রচুর পড়তে হবে। প্রতিদিন পত্রিকার ছাপা কাগজ পড়তে হবে। রাজনীতি সম্পর্কে জানতে হবে। রাজনীতির রিপোর্ট পড়তে হবে। বই পড়তে হবে। সিনেমা দেখতে হবে। কোনো বিষয় সম্পর্কে লিখতে হলে পূর্ণাঙ্গ ধারণা থাকতে হবে।
উল্লেখ্য, প্রথম আলো বন্ধুসভার ভার্চ্যুয়াল লেখালেখি কর্মশালার চতুর্থ ও শেষ পর্ব অনুষ্ঠিত হয় ৫ জুন। কর্মশালায় ‘সংবাদ’ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন প্রথম আলোর হেড অব ডিপ নিউজ রাজীব আহমেদ। ওপরের লেখাটি তাঁর আলোচনার প্রতিলিপি।