ঘোড়া ‘রকি’র পিঠে ভর করে স্বপ্ন বুঁনছে সোহেল
গত মে মাসে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে ঘুরতে যাই। লাবণী পয়েন্টে হাঁটছিলাম। সাগরের গর্জন আর মানুষের কোলাহলের মধ্যে হঠাৎ একটি দৃশ্যে চোখ আটকে গেল। বিশাল সমুদ্রের পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটি ছোট্ট ঘোড়া, পাশে ছোটখাটো এক কিশোর দৌড়ে বেড়াচ্ছে আর মানুষের কাছে গিয়ে গিয়ে বলছে, ভাই ঘোড়ায় উঠবেন? ৫০ টাকা, ৪০ টাকা—দামাদামি করছে। ছেলেটির চেহারায় ক্লান্তির ছাপ নেই, রয়েছে একরাশ প্রাণ আর নিষ্পাপ হাসি।
দুপুরের রোদের ঝিলিকে চকচক করছে দাঁড়িয়ে থাকা ঘোড়ার গা। কৌতূহল নিয়ে কাছে গেলাম। কিশোরটির নাম সোহেল। চোখে একরাশ স্বপ্ন আর ক্লান্তিমিশ্রিত প্রত্যাশা। বয়স মাত্র ১৪। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রঙিন ফুল ও ঘণ্টায় সাজানো ছোট্ট ঘোড়াটির নাম ‘রকি’, সোহেলের প্রিয় বন্ধু।
রকি সৈকতের বাতাসে হাঁটতে হাঁটতে সোহেলের স্বপ্ন বহন করে বেড়ায়। তার স্নেহ আর যত্নে ঘোড়াটিকে মনে হয় যেন তারা দীর্ঘদিনের সঙ্গী। রকিকে খাওয়ানো থেকে শুরু করে সাজানো—সবকিছুতেই সোহেলের মমত্ব। দিনভর সৈকতে ঘোড়ার পিঠে মানুষ তোলে সে। শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ—সবাই কিছু সময়ের আনন্দ কিনতে চায় রকির পিঠে চড়ে। আর সোহেল তার ছেলেমানুষি হেসে গড়িয়ে দেয় অন্যদের মুখে। তবে এই হাসির আড়ালে আছে এক কঠিন বাস্তবতা।
কথায় কথায় জানতে পারি, সোহেল ঘোড়াটির মালিক নয়। মাসে মাত্র ছয় হাজার টাকা মজুরিতে সে কাজ করে। সারা দিন যে আয় হয়, তার পুরোটাই মালিকের হাতে তুলে দেয়। এরপর সেই আয় থেকে তাকে মাসিক বেতন দেওয়া হয়। বেতনের টাকা তুলে দেয় মায়ের হাতে। বাবা নেই, আছে এক ছোট ভাই। মায়ের মুখের হাসিটুকুই যেন সোহেলের জীবনের একমাত্র প্রাপ্তি। মা কাজ করেন মানুষের বাসায়, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খেটে চলেন। দুজনের স্বল্প আয়ে সংসার চলে।
মায়ের সঙ্গে সোহেল কক্সবাজারের লাবণী সৈকতের কাছাকাছি একটি ছোট বস্তিতে থাকে। কিশোরটি জানে, এই সংসারের ভার অনেক বড়, কিন্তু তার কাঁধে সেই ভার বইতেই হবে। তাই মাস শেষে যতটুকু রোজগার হয়, কোনো প্রশ্ন না করে নিঃশব্দে তুলে দেয় মায়ের হাতে। একটা ছোট্ট ইচ্ছার কথাও জানায় সোহেল। সে বলে, ‘যদি উপার্জন আরেকটু বেশি হতো, তাহলে মাকে আর কষ্ট করে মানুষের বাড়িতে কাজ করতে হতো না।’
সোহেলের কাছে রকি শুধু একটি ঘোড়া নয়, জীবনসঙ্গী। সৈকতে কেউ যদি তাকে কিছু খেতে দেয়, সে আগে রকির মুখে তুলে দেয় খাবার। সোহেল বলে, ‘রকি আমার মনের কথাও বোঝে।’
রকির বয়স কম। আকারেও সৈকতের অন্য ঘোড়াগুলোর তুলনায় ছোট। হয়তো এ জন্যই তাদের দুজনের মধ্যে একধরনের বোঝাপড়া গড়ে উঠেছে। নামটাও সোহেলের দেওয়া।
দয়াগঞ্জ, গেন্ডারিয়া, ঢাকা