স্মৃতির আয়নায় শরৎপ্রেম
কাঁচা ধানের গন্ধে ভরা এক শরৎ বিকেল ছিল সেটা। আকাশে তুলার মতো মেঘ, নদীর পাড়ে বাতাসে কাশফুলের দোলা। খালে-বিলে হাঁটুজলে আমরা কজন মিলে শাপলা তুলছিলাম। জলের নিচে লুকিয়ে থাকা শালুক ছোঁয়ার সময় মনে হতো যেন পৃথিবীর সবচেয়ে নরম জিনিসটাকে ছুঁয়ে ফেলেছি। মা দূর থেকে ডাক দিয়ে বলত, ‘বাবা, রোদ পড়ে যাচ্ছে, ঘরে আয়।’
আমি শুনেও শুনি না।
শরতের বিকেল তখন মধুর মতো গাঢ় হয়ে নেমে এসেছিল। সূর্যের আলোয় জল ঝলমল করছে। মনে হচ্ছিল—এ মুহূর্তটাই হয়তো জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়।
সন্ধ্যার আগে আমরা দৌড়ে বাড়ি ফিরি। পথে কাশফুলের সারি, মাঠে সবুজ ধানের শিষ। আর বাতাসে এমন এক ঘ্রাণ—যা আজও ভুলতে পারিনি।
সেই ছিল আমার শৈশবের শরৎ। এখনো চোখ বন্ধ করলে দেখি, সাদা কাশফুলের ভেতর দিয়ে বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়াচ্ছি। ধানের খেতে ধোঁয়াটে রোদ পড়ে আছে। আর আমি হাঁটুজল থেকে একমুঠো শাপলা হাতে নিয়ে ভাবছি, এই ফুলগুলো বোধ হয় মেঘ থেকে নেমে এসেছে।
তারপর বছর কেটে যায়। কৈশোর এল নরম মেঘের মতো। তখন শরৎ মানে শুধু শাপলা নয়, শিউলি ফুলের গন্ধও। কৈশোরে শরৎ মানে অন্য রকম এক রহস্য। স্কুলের মাঠে ঝরা শিউলির পাপড়ি, নীল আকাশে উড়ন্ত ঘুড়ি আর মনজুড়ে প্রথম কারও মুখ।
প্রেমের প্রথম চিঠিও লিখেছি ঠিক এই ঋতুতেই। স্কুলের বারান্দায় বসে দূরের কাশবন দেখে ভাবতাম, যদি সে হঠাৎ এই পথে আসত! একদিন স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফেরার পথে দেখি, কাশবনে দাঁড়িয়ে আছে সে। চুপচাপ, হাতে শিউলি ফুল। বলল, ‘আজ আকাশটা কত নীল, তাই না?’ আমি কিছু বলতে পারিনি। শুধু মনে হয়েছিল, শরতের মেঘগুলোও বুঝি আজ থেমে গেছে। আমার বুকের ভেতরের আলোটা যেন নরম হয়ে উঠছে।
সেই কৈশোরে শরৎ মানে ছিল প্রত্যাশা, স্বপ্ন আর গোপন কম্পন। রাতের আকাশে চাঁদ উঠলে মনে হতো, ওই আলোয় আমার চিঠিটা হয়তো তার জানালায় পৌঁছে গেছে। শিউলির গন্ধে ভিজে থাকত খাতা, কলম, দুরন্ত মন—সবকিছু। তখন বুঝিনি, তার সংলাপের নীল আকাশই একদিন আমার ভেতরটাও নীল করে দেবে।
তারুণ্যে এসে শরৎ এক অন্য রকম রূপ নিল। এবার আমি শহরে। উঁচু দালান, যান্ত্রিক শব্দ, ব্যস্ত রাস্তায় কোথাও শরতের নীল নেই। তারুণ্যে এসে শরৎ যেন শহরের কংক্রিটে বন্দী। ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে চোখ রাখলে দেখি সাদাকালো মেঘের টুকরা নীলে ভেসে বেড়ায়। কিন্তু কোথাও হাঁটুজলে শাপলা নেই, নেই কাশবন। যেখানে সূর্য ডোবার আগে লাল আভায় ভরে যেত চারদিক। সেদিনকার শাপলা ফুলগুলো যেন এখন অফিসের টেবিলের ওপর রাখা নোটবুকের মতোই নির্জীব।
অফিস থেকে ফেরার পথে রাস্তায় বিক্রেতার হাতে গোলাপ, রজনীগন্ধা চোখে পড়ে। আমি থেমে দেখি, কিন্তু কিনি না। ভেতরে কোথাও একটা কষ্ট টানে। ফুলগুলো যতই সুন্দর হোক, ওদের মধ্যে শাপলার মতো স্নিগ্ধতা নেই। রাতের বেলায় যখন ফ্যান ঘোরে মাথার ওপর, মনে পড়ে যায় সেই হাঁটুজল, যেখানে শালুক তুলতে গিয়ে আমরা প্রাণখুলে হাসতাম। একে অপরকে ছিটিয়ে দিতাম ঘোলা জল।
এখনো মনে হয়, যদি একবার ফিরে যাওয়া যেত শৈশব কিংবা কৈশোরে। শরতের বিকেলে নদীর ঘাটে বসে সূর্যাস্ত দেখা যেত, তাহলে এই শহরের ধোঁয়াটে নিশ্বাসটা একটু হলেও হালকা হতো।
মধ্যবয়সের শরৎ মানে ফিরে দেখা। এই বয়সে দাঁড়িয়ে বুঝি, শরৎ আসলে একটা আয়না। যেখানে জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখা যায় স্পষ্টভাবে। একদিন ছেলেকে বললাম, ‘চলো, তোমাকে গ্রামে নিয়ে শরতের কাশবন, সবুজ ধানখেত, পথের ধারে শাপলা–শালুক দেখিয়ে আনি।’ সে হেসে বলল, ‘ওখানে কি ওয়াই–ফাই আছে?’ আমি হাসলাম, কিন্তু বুকের ভেতরটা কেমন হু হু করে উঠল।
ভাবলাম, এই প্রজন্মের শরৎ বুঝি কেবল মোবাইলের পর্দায় বন্দী। তারা জানে না হাঁটুজল কেমন ঠান্ডা, জানে না কাশফুলের দোল কতটা প্রশান্তির।
তবু ঠিক করলাম—একদিন নিয়ে যাবই। পরের সপ্তাহেই গেলাম গ্রামে। সকালবেলা ছেলেটা প্রথমে অনীহাভরে ফোনে গেম খেলছিল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে ওর চোখে কৌতূহলের ঝিলিক। কাশফুলের সারি দেখে বলল, ‘বাবা, এ যেন তুলোর মাঠ!’ তারপর খালের হাঁটুজলে নামল।
আর শাপলা তুলতে গিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘বাবা, দেখো! আমি পেলাম!’
বিকেল গড়িয়ে গেল ফড়িং ধরার খেলায়। পাঠশোলার মাথায় জিগার আঠা লাগিয়ে ওরা গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে ফড়িংয়ের পেছনে দৌড়াচ্ছে। ঘেমে গায়ের টি-শার্ট ভিজে গেছে। তবু ফড়িং ধরার নেশা কাটে না।
মোবাইল কোথায় আছে, ও নিজেও ভুলে গেছে। সন্ধ্যা নামলে ও এসে আমার পাশে বসে বলল, ‘বাবা, এখানে নেটওয়ার্ক নেই ঠিকই; কিন্তু এত আলো–হাওয়া, এত ফুল–পাখি দেখে অভিভূত হয়েছি। এমন আনন্দ আর কোনো দিন পাইনি।’
আমি ওকে বুকে টেনে বললাম, ‘এই হলো শরৎ, বাবা। যে শরৎ শুধু ছবিতে নয়, মন আর মাটিতে মিশে থাকে।’
শেষ বয়সে শরৎ যেন এক প্রার্থনা। আঙিনায় বসে থাকি, দেখি কাশফুলের মতোই সাদা হয়ে গেছে আমার চুল। আকাশে মেঘ ভাসে, হালকা রোদে চোখ জ্বলে গরম জল বেরিয়ে আসে। তবু মনে হয়, শরৎ এখনো আমার পাশে। এক বিকেলে হঠাৎ মন চাইল—যদি একবার নদীর পাড়ে যাওয়া যেত!
সন্তানেরা বলল, ‘বাবা, তোমার হাঁটা কঠিন হবে।’ তবু গেলাম।
নদীটা আছে, কিন্তু আগের মতো জলের স্রোত নেই। মাঝনদীতে চর পড়েছে। নদীর পাড় ভরাট করে কিছু বাড়িঘর উঠেছে। চারপাশে কংক্রিটের বেড়া। রাস্তার ধারে খালে-বিলে এখন আর শাপলা ফোটে না। আমি ঝুঁকে জল ছুঁলাম, জলের মধ্যে নিজের মুখ দেখলাম। এক ক্লান্ত মানুষ, যার চোখে এখনো কাশবনের দোল খেলে যায়। বুকের ভেতর হঠাৎ এক নিঃশব্দ শান্তি নেমে এল। মনে হলো, শরৎ কখনো ফুরোয় না। ও কেবল রূপ বদলায়। একসময় জলে, একসময় মেঘে, আর এখন শুধু স্মৃতির ভেতরে।
আকাশে তখন সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। বাতাসে কাঁচা ধানের মিষ্টি ঘ্রাণ। চোখ বন্ধ করলে দেখি, শৈশবের আমি এখনো হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে আছি। হাতে একমুঠো শাপলা, মুখে হাসি। সেই হাসিটাই হয়তো আমার জীবনের সব ঋতুর ওপরে ভেসে আছে। অমলিন, অনন্ত, শরতের মতোই নরম ও দীপ্ত।
টঙ্গী কলেজ গেট, গাজীপুর