স্মৃতিতে শৈশবের ঈদ

ছবি: এআই/বন্ধুসভা
বিজ্ঞাপনভর্তি সেই বাংলা সিনেমাই আমাদের প্রিয় ছিল। টানা সাত দিন ঈদের সিনেমা দেখার জন্য হলেও বারবার ঈদ চাইতাম মনে মনে।

শৈশবের ঈদের দিনগুলো ছিল রঙিন। কোনো বিষাদ কিংবা একাকিত্ব—কিছুই ছিল না তখন। ঈদ মানে বুঝতাম আনন্দ। একটা রঙিন উৎসব। নতুন জামা, নতুন জুতা আর বাড়িভর্তি মানুষ। ঈদের সপ্তাহ দুয়েক আগেই স্কুল বন্ধ হয়ে যেত। পড়া কম, খেলা বেশি—এটাই ঘটে থাকত সচরাচর। কখনো ফুটবল, কখনো কাঁঠালপাতার টাকা দিয়ে দোকান, লুকোচুরিসহ আরও হরেক রকমের খেলার বন্দোবস্ত হয়ে যেত। দিনশেষে থাকত দাদুর বকুনি, ‘সইন্ধ্যা অইতাছে, এহনো তোদের খেলা ভাঙ্গে না। কইঞ্চাডা লইয়া আইতাছি খাড়া।’

ঈদের দিন সাতেক আগে থেকেই শুরু হতো নতুন জামার জন্য ঘ্যানঘ্যানানি। আব্বার সামনে দাঁড়িয়ে বলার সাহস ছিল না কারোরই। আমরা বলতাম আম্মার কাছে, আম্মা এইবার ঈদে কিন্তু নতুন জামা লাগবই। একবার, দুইবার, অনেকবার। আমরা সাত ভাইবোন। সবাই একসঙ্গে কখনো নতুন জামা পেতাম না। দুই ঈদে ভাগাভাগি করে পেতাম। যারা আগে পেয়েছে, তারা এবার পাব না। যারা পাইনি, তারা পুরোনো কাপড় ধুয়ে, মাড় দিয়ে তারপর ইস্তিরি করে পরতাম। একটু খারাপ লাগত, কিন্তু সেটা নামাজে যাওয়ার পর হারিয়ে যেত। সেসব আর মনে রাখতাম না।

যেবার ভাগ্য ভালো হতো, আব্বার সঙ্গে মার্কেটে যেতাম। সেই খুশি আর দেখে কে। নতুন কাপড় এনে কাউকে খুলে দেখাতাম না। দেখালে পুরোনো হয়ে যাবে। অপেক্ষায় থাকতাম কখন গায়ে দেব। আর ঈদগাহে যাব। আগের দিন রাতে হাতের মধ্যে মেহেদি দিয়ে দিত বড়রা। আমাদের ছোটদের জন্য তখন ওই একটাই ডিজাইন, হাতের তালুতে একটা বড় চ্যাপ্টা গোল আর আঙুলের মাথা ঢেকে দেওয়া। রাতে বিছানাজুড়ে সেসবের ছড়াছড়ি। যতটুকু রং হতো, তাতেই খুশি।

কোরবানির ঈদকে আমরা বড় ঈদ বলতাম। মনের ভেতর একটা উত্তেজনা কাজ করত যে কখন কোরবানি করা হবে। কোরবানির পশুর আশপাশে ঘুরঘুর করতাম। নামাজের পর দৌড়ে আগেই চলে আসতাম। অপেক্ষা করতাম কখন সবাই আসবে আর কোরবানি দেবে। সমবয়সীদের একটা ছোট্ট পর্যবেক্ষক দল ছিল। কীভাবে কী করবে সব আলোচনা হয়ে যেত নিজেদের মধ্যে। কোরবানির সময় আমরা দূর থেকেই লুকিয়ে দেখতাম। কাছে যাওয়ার সাহস পেতাম না। ভাবতাম, যদি গরুটা হঠাৎ উঠে আসে কিংবা দৌড়ে চলে যায়, কী হবে তখন?

পশু কাটার সময় একটা জিনিসের খোঁজ নিতাম সব সময়। ঢোল বানানোর পর্দা। যেটা কোনো কৌটা কিংবা অন্য কিছুতে লাগিয়ে রোদে শুকালে, ঢোলের মতো বাজানো যেত। এসবের ফাঁকে গোশত ঘরে আনার দায়িত্বও পড়ত মাঝেমধ্যে। ঘরভর্তি মসলার ম–ম গন্ধ। দাদুর কাছে দেখতাম অনেকেই আসত। বসে গল্প করত। দাদু সবাইকে কোরবানির গোশত দিয়ে দিতেন। আশপাশের ঘরে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব ছিল আমাদের। কিন্তু কেউ যেতে চাইতাম না। গেলেই খেয়ে আসতে হতো। আর কিছু না হোক, পায়েস কিংবা সেমাই ক্ষীর।

গোশত রান্না হওয়ার সময় রান্নাঘরে উঁকি দিতাম অনেকবার। কখন রান্না হবে আর কখন খাব। ঈদ চলে যাচ্ছে। ঈদের সিনেমা দেখা বাকি। আমাদের ঘরে টিভি ছিল না। পাশের ঘরে সবাই জড়ো হতাম। বিটিভি ছাড়া তখন আর কোনো অপশন ছিল না। বিজ্ঞাপনভর্তি সেই বাংলা সিনেমাই আমাদের প্রিয় ছিল। টানা সাত দিন ঈদের সিনেমা দেখার জন্য হলেও বারবার ঈদ চাইতাম মনে মনে। কখনো কখনো বড় ফুফুর বাড়ি যেতাম সবাই মিলে। হেঁটে হেঁটে যেতে হতো, চার-পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা। ঈদ আর নতুন জামার আনন্দে পথের দূরত্ব কিছুই ছিল না। সন্ধ্যার আগে আগে দৌড়াতে দৌড়াতে চলে আসতাম আবার। ভাবতাম, এই বুঝি ঈদ চলে গেল।

নিশ্চিন্তপুর, বারহাট্টা, নেত্রকোনা