বিহঙ্গসখা

বাবার কোলে লেখক, ১৯৯৩ সালছবি: লেখকের সৌজন্যে

তখন কেবল সুকুমার রায়ের ছড়া পড়া শুরু করেছি। আমাদের পাকিস্তানি আমলের পুরোনো বাড়ির উত্তর জানালায় একটা কামিনী ফুলের গাছ ছিল। এক হেমন্তের দুপুরে সেই হালকা মরচে পড়া লোহার চার খোপের জানালার ঝাপসা প্লেইন গ্লাসে একটা ছোট কালো লম্বা চিকন ঠোঁটের পাখি এসে ঠোকর দিচ্ছিল। পাখিটি আগে কখনো দেখিনি। আব্বুর মুখে শুনেছিলাম এটাই মৌটুসী পাখি। আমার পাখি চেনার হাতেখড়ি আব্বুর কাছ থেকেই।

আশ্বিন মাসের কোমল সকালগুলোতে উঠানে লাফিয়ে বেড়াত সাদা খঞ্জনা পাখি। চিকচিক ডাকত আর লেজ নাচাত। আব্বু বলত, দেখিস একটু পরে এর জোড়াটা এসে পড়বে। বলতে বলতে আরেকটি খঞ্জনা এসে পড়ে। অবোধ পাখিদের কীভাবে প্রেম হয় জানি না। আব্বু কখনো বলেনি।

আমাদের পুরোনো রান্নাঘরের পাশে রাতে যখন খেতে বসতাম, তখন বাঁশের ছাউনির নিচ থেকে হঠাৎ একটা পাখি বেরিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যেত। আবার হঠাৎ একইভাবে এসে চট করে ঢুকে যেত বাঁশের ফাঁকে।

আমাদের পশ্চিমে শিলালিয়া গ্রামের পাশের মাঠে আর বেড়িবাঁধের ওপরটায় পাখির ছড়াছড়ি। কার্তিকের বিকেলে আব্বুর সঙ্গে মেঠোপথে হেঁটে যাওয়ার সময় ভাতশালিকের চেঁচামেচিতে মুখর হয়ে থাকে দিগন্তবিস্তৃত মাঠটা। হট্টিটি পাখিরা ছোট ছোট মেঠো ফাটল থেকে পোকা শিকারে ব্যস্ত থাকে। আমাদের দিকে ভ্রুক্ষেপ থাকে না। হাঁটতে হাঁটতে আব্বু তাঁর ছেলেবেলার এক মেজাজি ফিঙে পাখির কবলে পড়ার গল্প বলতে থাকে। বাবুই পাখির বাসা বোনার গল্প, জোনাকি শিকারের গল্প শোনায়। বকুলগাছের ডালে বসন্তবাউরির ডাক চিনিয়েছিলেন তিনি। ছোট ঠোঁটের সবুজ পাখিটাকে অনেক দিন দেখিনি, কিন্তু ডাকটা এখনো কানে বাজে। শীতের শেষের দিকে বাড়ির সামনে পারিজাতের ডালে মাঝেমধ্যে আসত এক জোড়া মোহনচূড়া। আব্বু বলেছিল, এটাই সেই নবী সোলাইমানের হুদহুদ পাখি। বলতে বলতে আব্বু চলে যায় বিলকিস আর সোলাইমানের উপাখ্যানে।

উপাখ্যানের শেষ হতে হতে বিকেলের রোদে পুকুরের পাড়ে ডাহুকের ডাক শুরু হতো। বাদশা সোলাইমানের উপাখ্যান মোড় নিত জীবনানন্দের দিকে— ‘...বেতের লতার নিচে চড়ুইয়ের ডিম যেন শক্ত হয়ে আছে।’ এভাবেই অনেক বছর আমার মনে জীবনানন্দের বীজ বুনে গিয়েছিল আব্বু।

ধীরে ধীরে শীত আসত। সাবিত্রী আশ্রমের দিঘিতে দলবল নিয়ে চলে আসত অতিথি পাখি। সরালি হাঁস, লালশির হাঁস, ফুলুরি হাঁস, চখাচখি, তিলি হাঁস...কত কত পাখির মেলা। ওদের ভিড়ে দিঘির পানিটাও দেখা যেত না মাস দুয়েক। একটু শব্দ হলেই ঝাঁক বেঁধে উড়াল দিয়ে চক্কর দিত দিঘির চারপাশে। তারপর ক্লান্ত হয়ে আবার দিঘির পানিতে বসে পড়ত।

ঘোষের হাটের এক কচুরিপানা–ভর্তি পুকুরের পাশে ভোরে হাঁটার সময় অল্প কুয়াশায় এক দীর্ঘপদী পাখিকে দেখি। পান্না সবুজ পালকের ওপর ব্রোঞ্জ কালারের ডানা পাখিটার। নিঃশব্দে কদম ফেলে হেঁটে চলেছে পানার ওপর দিয়ে। আব্বু বলল, ‘ওটা জলপিপি’। এখনো জলপিপি চিনতে ভুল হয় না আমার। সকালের গাঢ় কুয়াশা একটু পরিষ্কার হলে চন্দ্রকলা সেতুর পাশে দিগন্তবিস্তৃত মাঠে দেখতাম শামুকখোল পাখিদের। তাদের সঙ্গে ভারি বন্ধুত্ব জমাত লম্বা গলার বিশাল সাদা বকেরা। হাঁটতে হাঁটতে আব্বু তাঁর ছোটবেলায় বক শিকারের গল্প শোনাতেন।

বসন্তের প্রথম দিকে শুক্লাম্বরের দিঘির ধারে শতবর্ষী বটের ফল খেতে ভারি সুন্দর এক হলদে পাখি আসত। আব্বু চিনিয়েছিল সেটাই হরিয়াল পাখি। এত মুগ্ধতা ছড়ানো পাখি আমি খুব কম দেখেছি। নগরায়ণের ফলে বট আর তালগাছ কমে আসছে দ্রুত। বাস্তুচ্যুত বাবুই আর হরিয়ালদের কথা বলতে বলতে আব্বুর কণ্ঠ ভারী হয়ে আসত; যেন ওনার শালের নিচে এসে হাজার হাজার হরিয়াল আর বাবুই পাখি সকরুণ চোখে আশ্রয় চাইছে এই আগ্রাসী মানবজাতি থেকে।

তিশরী গ্রামের এক ভাঙা রাস্তার পাশে ধুন্ধুলের মাচার ওপরে কাজল আঁখি পাখির সঙ্গে পরিচয়। এটাকে কালোমাথা কসাই বলেও চেনে অনেকে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে এটার ডাক শুনলাম আব্বু আর আমি। এখনো চোখ বুজলেই কাজল আঁখির ডাক শুনতে পাই। ক্ষেত্রপাল মাঠের ধারে বিদ্যুতের লাইনের ওপরে ঝাঁক বেঁধে লাটোরা পাখিরা বসে। উড়ে যাওয়ার ভয়ে দূর থেকে আব্বু দেখায় পাখিগুলোকে।

আমাদের পুকুরপাড়ে ঝুঁকে পড়া পেয়ারাগাছের ডালে বড় এক মাছরাঙাকে দেখে একবার আব্বুকে ডেকে আনি। আব্বু বলে ‘ওটা মেঘহও, মাছরাঙাদের একটা প্রজাতি’। মেঘহওকে নিয়ে আমি ছড়া লিখেছিলাম।

সন্ধ্যায় ডুবুডুবু সূর্যের আলোয় আমাদের হলুদখেতে এক লালচোখের পাখি দেখে ভয় পেয়ে যাই। কুচকুচে কালো পালকের ওপরে ইটা রঙের দুটি পাখনা আর সঙ্গে রক্তাভ চোখ। আব্বু বলেছিল সেটা কানাকোকা বা কানকুয়া। ভয়ালদর্শন এই নিরীহ পাখির চেহারা এখনো কেমন জানি ভয়ের সমার্থক হয়ে আছে আমার কাছে।

আমাদের পুরোনো রান্নাঘরের পাশে রাতে যখন খেতে বসতাম, তখন বাঁশের ছাউনির নিচ থেকে হঠাৎ একটা পাখি বেরিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যেত। আবার হঠাৎ একইভাবে এসে চট করে ঢুকে যেত বাঁশের ফাঁকে। কখনো সামনাসামনি দেখা হয়নি। একদিন মাঠের ঘাসে শুয়ে আব্বু অনেক ওপরে উড়তে থাকা কিছু লেজ চেরা পাখিকে দেখিয়ে বলেছিল, এটাই সেই রান্নাঘরের রহস্য পাখি আবাবিল। এই সেই কোরআনের আবাবিল পাখি! শিরশিরে অনুভূতি এসে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যেত। আমি কতবার আবাবিলের মতো রহস্যময় আর বিখ্যাত হতে চেয়েছিলাম। পারিনি।

তারপর কত ঋতু কেটে যায়। আব্বুর সঙ্গে গ্রামের পথে, পাহাড়ে, নদীর তীরে হেঁটে বেড়াই আর পাখি দেখি-চিনি। উঠানের লেজ–নাচানি পাখি, কাঁঠালগাছে বেনেবউ, কর্ণফুলীর পাড়ে শঙ্খচিল, সাঙ্গু নদীর চরে চা-পাখিদের চিনে কৈশোর কেটেছে। আব্বু আমার পাখিজগতের দূত হয়ে স্বপ্নে নেমে আসতেন। আব্বুর ত্বকের উজ্জ্বলতা কমে এসেছে, চামড়া কুঁচকে এসেছে, বিভিন্ন রোগ গজিয়ে উঠছে দেহে। কিন্তু আমার জন্য আব্বু সেই সবুজ সুইচোরা পাখিটি হয়ে আছে, যার সৌন্দর্য আমৃত্যু থেকে যায়। আব্বু আমার জন্য ‘বউ কথা কও’ পাখির ডাক হয়ে আছে, বসন্তের কোমল দুপুরে নিভৃত জানালা দিয়ে যেটার ডাক শুনে শুনে ঘুমের অতলান্তে হারিয়ে যাওয়া যায় নিশ্চিন্তে। অনেক ভালো থাকো আব্বু।

পটিয়া, চট্টগ্রাম