যেন এক খণ্ড স্বর্গ পৃথিবীতে নেমে এসেছে

কাশ্মীরের বিভিন্ন উপত্যকা ঘোরার জন্য পরিবহন হচ্ছে ঘোড়া
ছবি: লেখক

রাস্তার দুই পাশে সারিবদ্ধ রংবেরঙের কাঠের বাড়ি আর বনসদৃশ পাহাড়। কোথাও চোখে পড়ে পাহাড়ি ঝরনাধারা আর অন্য পাশে লেকসংবলিত সুউচ্চ পাহাড়। পাশেই আপেলবাগান, জাফরানখেত, বিস্তীর্ণ জলাশয় ও লেক। জলাশয়ে নানান প্রজাতির পাখি-হাঁস মনের রঙে চরে বেড়াচ্ছে। ইচ্ছা করবে সেখানেই থেকে যাই! যেদিকেই চোখ যায়, এমন নয়নাভিরাম দৃশ্য আপনাকে মুগ্ধ করতে বাধ্য।

চাকরির কারণে ব্যস্ত থাকতে হয় সারা বছরই। তা–ও প্রতি মাসে চেষ্টা করি সময় বের করে দূরে কোথাও ঘুরে আসতে। মন যেমন ফ্রেশ থাকে, তেমনই কাজে চাঞ্চল্য খুঁজে পাই। বৃহস্পতিবার রাতে বেরিয়ে পড়ি, সঙ্গে কয়েকজন বন্ধুও জুটে যায়। শুক্রবার সারা দিন ঘুরে শনিবার সকালে ঢাকায় এসে অফিস করি। দীর্ঘদিন ধরেই ইচ্ছা ছিল ভারতের কলকাতা ও আগ্রার তাজমহল দেখতে যাব। সে উদ্দেশ্যেই ভিসা নেওয়া। কিন্তু বন্ধুরা জোরাজুরি শুরু করে, ভারত যেহেতু যাব, কাশ্মীর কেন নয়?

আগে যাঁরা সেখানে গিয়েছেন, তাঁদের পরামর্শ হলো কাশ্মীর ভ্রমণের উপযুক্ত সময় জুলাই মাস। আগেই বিমানের টিকিট কেটে ফেলি। এসে যায় নির্ধারিত সময়। দেশের সবাই যখন ঈদুল আজহা উদ্‌যাপনে ব্যস্ত, আমি, পাবেল, অমিত ও আতিক তখন ব্যাগ গোছানোতে মগ্ন। ১০ জুলাই ঈদের দিন বিকেলে আমরা চার বন্ধু বেরিয়ে পড়ি স্বর্গীয় সৌন্দর্যের খোঁজে। বিমানবন্দরে তেমন ঝামেলা পোহাতে হয়নি, মানুষ কম। অল্প সময়ের মধ্যে সব কাজ শেষ করে উঠে বসি বিমানে।

কাশ্মীরের স্বর্গীয় উপত্যকার মাঝে লেখক
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

দিল্লিতে দুই ঘণ্টার ট্রানজিট থাকায় শ্রীনগর শেখ উল আলম বিমানবন্দরে পৌঁছাতে রাত ১১টা ৪০ বেজে যায়। রাতে বিমান থেকে কাশ্মীরের সৌন্দর্য চোখে পড়েনি। বিমানবন্দরে প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে হোটেলে পৌঁছাতে মধ্যরাত হয়ে যায়। এদিকে সবার ক্ষিদে লেগেছে, কিন্তু কোনো রেস্তোরাঁ খোলা পাইনি। রাস্তাঘাট জনমানবহীন, সশস্ত্র বাহিনী ছাড়া কাউকে চোখে পড়েনি। হোটেলের ক্যানটিনও বন্ধ হয়ে গেছে। রাতে হোটেল কর্তৃপক্ষের দেওয়া শুকনা বিস্কুট খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ি।
দীর্ঘ জার্নিতে ক্লান্তি থাকায় পরদিন ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে যায়। আমাদের প্রথম গন্তব্য গুলমার্গ। এটিকে বলা হয় কাশ্মীরের স্বর্গীয় উপত্যকা। পাহাড়, নদী, পাইন, দেওদার ও ফারের জঙ্গল আর পাহাড়ের ওপর তুলার মতো বরফ মিলিয়ে সবুজ ও সাদার নিবিড় মায়ার মাখামাখি। যেন এক খণ্ড স্বর্গ পৃথিবীতে নেমে এসেছে। সকাল ১০টার দিকে বের হই। আমাদের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করে দেয় হোটেল কর্তৃপক্ষ। দৈনিক ভাড়া ৩ হাজার ৫০০ রুপি। শহরের গণ্ডি পার হতেই চোখ ছলছল করে ওঠে, সারিবদ্ধ কাঠের বাড়ি, বনসদৃশ পাহাড়। চারদিকে ফুল আর ফুল। অবাক করা বিষয় হলো, এই ফুলগাছ কারও হাতে গড়া বাগান নয়, প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি।

গুলমার্গ যাওয়ার পর ঘোরার জন্য ঘোড়া নিলাম, ভাড়া ১০০০ রুপি। চাইলে মোটরসাইকেলও নেওয়া যায়, তবে অর্থ খরচ করতে হবে বেশি। ঘণ্টা দুয়েক ঘোরার পরও তৃপ্ততা আসেনি, যদি আরও কিছুক্ষণ থাকতে পারতাম। নিয়ন্ত্রিত এলাকা হওয়ায় আমাদের বিকেল চারটার আগেই শ্রীনগর পৌঁছাতে হয়। পথিমধ্যে কাশ্মীরি শাল আর কুর্তা কিনি। শহরের বাইরে থেকে কেনা ভালো, ১৫০ রুপি থেকে দাম শুরু হয়ে ৫–৬ হাজার পর্যন্ত আছে। এগুলো স্থানীয় নারীদের হাতে তৈরি। সন্ধ্যায় শহর ঘুরে দেখি। স্থানীয় মাংসজাতীয় খাবার রগান জোস, ইউগার্ড লাম্বকারী খাই, সঙ্গে ভুট্টার রুটি পর্যটকদের কাছে অনেক আকর্ষণীয়। সেগুলোর স্বাদও নিই আমরা। দাম সাধ্যের মধ্যেই।

ভ্রমণ সঙ্গী চার বন্ধু
ছবি: লেখক

পরদিন যাই পেহেলগামে। রাস্তার একপাশে ঝরনাধারা, রাশি রাশি পানি পাথরের ভেতর দিয়ে প্রচণ্ড বেগে গড়িয়ে পড়ছে। সেই শব্দ কানের মধ্যে সুমধুর ধ্বনি সৃষ্টি করছে। অন্য পাশে লেকসংবলিত সুউচ্চ পাহাড়, আপেলবাগান ও জাফরানখেত। কিন্তু আমরা হতাশায় ডুবে গেলাম! এত এত মুগ্ধতা ছড়ানো স্থান, এক দিনে যে দেখে শেষ করা সম্ভব নয়। এখানেও পরিবহন বলতে ঘোড়া। তবে ভাড়া একটু বেশি, ২ হাজার রুপি করে নেয়।

এদিকে আতিক হঠাৎ অসুস্থ বোধ করে। তাঁকে নিয়েই আমরা বাইসারান হিলসের উদ্দেশে রওনা দিলাম। জায়গাটিকে স্থানীয় লোকজন মিনি সুইজারল্যান্ড বলে। সরু পাহাড়ি রাস্তা যেন আকাশের দিকে উঠছে, যত ওপরে উঠছিলাম, ততই মুগ্ধতা বাড়ছে, যেন ছোটবেলায় টিভির পর্দায় দেখা রবিনহুডের পাহাড়ি জঙ্গল। সেখান থেকে নেমে আসতে ইচ্ছা করছিল না। কিন্তু উপায়ও নেই। আতিকের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে পড়ায় ফেরার সিদ্ধান্ত নিই।

ডাল লেক যেন স্বপ্নপুরীর জলাশয়
ছবি: লেখক

ফেরার পথে চোখে পড়ল সারি সারি আপেলবাগান। গাড়ি থামিয়ে বাগানে ঢুকি। আপেলের জুস খাই। সারা দিনের খাবার বলতে এটুকুই। বন্ধুর অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় স্থানীয় আনন্টনাগ জেলা মেডিকেল কলেজে গিয়ে ১০ রুপির টিকিট কেটে ডাক্তার দেখাই। রোগীদের ভিড় আমাদের দেশের মতোই। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে এসেছি জানার পর আমাদের অবাক করে দিয়ে সবাই এমনভাবে সহযোগিতা করল যে এক মুহূর্তের জন্যও অপেক্ষা করতে হয়নি। দুই দফা ডাক্তার আর হাসপাতাল ঘুরে মাঝরাতে হোটেলে ফিরি।

তৃতীয় দিন আমাদের ফেরার পালা। তার আগে সকালে ডাল লেক দেখতে যাই। ৭.৪৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের লেকটি যেন স্বপ্নপুরীর জলাশয়, কাশ্মীরের বিশেষ নৌকায় যাতায়াত, হোটেল, ভাসমান বাজার, পদ্ম ফুল, মাঝখানে ছোট ছোট দ্বীপের মতো ঝোপঝাড়, অগণিত পাখির কোলাহল। আপনাকে মুগ্ধ করতে প্রকৃতি যেন তার সব উপাদান সাজিয়ে রেখেছে। লেকের পাশে মোগল গার্ডেন, যা মূলত ফুল দ্বারা আচ্ছাদিত সঙ্গে পাহাড়ি ঝরনা। গার্ডেনে ঢুকতে ২০ রুপিতে টিকিট কাটতে হয়। বাগান থেকে নাশপাতি পেড়ে খাই। কামড় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গাল বেয়ে রস বইতে শুরু করল।

ফিরতে ইচ্ছা করছিল না। আরও কয়েক দিন যদি থেকে যেতে পারতাম! দুপুরেই দিল্লির ফ্লাইট ধরতে হবে। তাই সরাসরি বিমানবন্দরে চলে আসি। আর সঙ্গে নিয়ে আসি জীবনভর গল্প করার মতো অজস্র স্মৃতি।

বন্ধু, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা