বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও গৌরবের ভান্ডার

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের ভেতরের দৃশ্যছবি: মারজিয়া অনন্যা

ঢাকার শাহবাগে দাঁড়িয়ে আছে এক মহিরুহ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর। শুধু নিদর্শন সংরক্ষণের স্থান নয়, এটি বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতার জীবন্ত পাঠশালা। ‘জাদুঘর সমাজের দর্পণ, জাতির শিকড়ের সন্ধানী’ দর্শনকে সামনে রেখে প্রতিষ্ঠিত এই জাদুঘর আজ দেশবাসীর জন্য ইতিহাসের এক পাঠশালা।

বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল ১৯১৩ সালের ৭ আগস্ট মাত্র ৩৭৯টি নিদর্শন নিয়ে ঢাকায় ‘ঢাকা জাদুঘর’ উদ্বোধন করেন। সেই ক্ষুদ্র পদক্ষেপ আজ বিস্তৃত হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ জাদুঘরে পরিণত হয়েছে। ১৯৮৩ সালের ১৭ নভেম্বর শাহবাগের চারতলা ভবনে নতুন অধ্যায় শুরু হয়। বর্তমানে জাতীয় জাদুঘরে নিবন্ধিত নিদর্শনের সংখ্যা ৯৩ হাজারের বেশি।

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের ভেতরের দৃশ্য
ছবি: মারজিয়া অনন্যা

জাতীয় জাদুঘর চারটি প্রধান বিভাগের মাধ্যমে ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে দর্শকের সামনে উপস্থাপন করে—ইতিহাস ও ধ্রুপদি শিল্পকলা, জাতিতত্ত্ব ও অলংকরণ শিল্পকলা, সমকালীন শিল্পকলা এবং প্রাকৃতিক ইতিহাস। ইতিহাস বিভাগের নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে প্রাচীন মুদ্রা, পোড়ামাটির ফলক, পাণ্ডুলিপি, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ–সম্পর্কিত অমূল্য সংগ্রহ। জাতিতত্ত্ব বিভাগে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জীবনধারা ও লোকজ শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়। সমকালীন শিল্পকলার গ্যালারিতে জয়নুল আবেদিন, এস এম সুলতান, কামরুল হাসানসহ ৩৩০ জন শিল্পীর শিল্পকর্ম আছে। প্রাকৃতিক ইতিহাস বিভাগ দর্শককে বিস্মিত করে সুন্দরবনের বন্য প্রাণী, বিরল মাছ, পাখি, সরীসৃপ থেকে শুরু করে বিশাল হাম্পব্যাক তিমির কঙ্কাল প্রদর্শনের মাধ্যমে।

বর্তমানে ৪৫টি গ্যালারিতে প্রায় ৬ হাজার নিদর্শন প্রদর্শিত হচ্ছে। জাদুঘরে রয়েছে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগ, মিলনায়তন, প্রদর্শনী কক্ষ এবং আধুনিক রসায়নাগার। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য গাইড সেবা ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের জন্য হুইলচেয়ার সুবিধা রয়েছে।

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর
ছবি: মারজিয়া অনন্যা

অতীতের মহিমা ধারণ করলেও দর্শনার্থীরা নানা ঘাটতির কথা তুলে ধরছেন। শিক্ষার্থী ইসতিয়াক আহমেদ বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আছে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী ঘটনা, ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ বা ২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থানসহ সাম্প্রতিক ইতিহাসের কোনো উল্লেখ নেই। অনেক গ্যালারি দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের নামে ফাঁকা পড়ে আছে।’ ইতিহাসের এই অসম্পূর্ণ অংশগুলো না দেখালে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দেশের ইতিহাসের পূর্ণতা জানতে পারবে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

জাতীয় জাদুঘরের অধীন বর্তমানে সাতটি শাখা রয়েছে—ওসমানী জাদুঘর (সিলেট), আহসান মঞ্জিল জাদুঘর (ঢাকা), জিয়া স্মৃতি জাদুঘর (চট্টগ্রাম), জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা (ময়মনসিংহ), স্বাধীনতা জাদুঘর (ঢাকা), পল্লিকবি জসীমউদ্‌দীন জাদুঘর (ফরিদপুর) এবং কাঙাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘর (কুষ্টিয়া)।

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের ভেতরের দৃশ্য
ছবি: মারজিয়া অনন্যা

প্রবেশমূল্য: স্থানীয়দের জন্য ৪০ টাকা, সার্কভুক্ত দেশীয়দের জন্য ৩০০ টাকা এবং অন্যান্য দেশের পর্যটকদের জন্য ৫০০ টাকা। প্রতিদিন হাজারো দেশি-বিদেশি দর্শক এই জাদুঘরের মাধ্যমে অতীত ও বর্তমানের সেতুবন্ধ অনুভব করেন।

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর নিছক ইতিহাস সংরক্ষণের জায়গা নয়; এটি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে এক সেতুবন্ধ। তবে দর্শনার্থীদের মতে, ইতিহাসের অপূর্ণ অধ্যায়গুলো অন্তর্ভুক্ত না হলে এই সেতুবন্ধ দুর্বল থেকে যাবে। জাতীয় জাদুঘর বাঙালির গৌরবময় অতীতের অমূল্য ভান্ডার হলেও এর পূর্ণতা নির্ভর করছে সময়োপযোগী সংস্কার ও ইতিহাসের যথাযথ প্রতিফলনের ওপর। সেটিই এখন কর্তৃপক্ষের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

আহ্বায়ক, সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা